সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনে নির্বাচনী উত্তাপ দৃশ্যমানভাবে বেড়েছে। জাতীয় নির্বাচনের এই আসনে পথসভা, গণসংযোগ, উঠান বৈঠক ও কর্মী সমাবেশে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে স্পষ্ট নির্বাচনী আবহ।
এই আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে উঠেছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থীর মধ্যে। যদিও আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে নির্বাচনে নেই, তবে আওয়ামী ঘরানার সম্ভাব্য একটি স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ঘিরে এলাকায় নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ভোটের একটি অংশ কোন দিকে যাবে, সেটি এখন পুরো আসনের প্রধান আলোচ্য বিষয়।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন সুনামগঞ্জ-২ আসন ছিল আওয়ামী লীগের প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শক্ত ঘাঁটি।
তবে ১৯৯৬ সালে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নাছির উদ্দিন চৌধুরীর চমকপ্রদ জয় এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ধারা বদলে দেয়। পরে তিনি বিএনপিতে যোগ দিয়ে আসনটিতে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলেন এবং দলীয়ভাবে নিজের অবস্থানও আরো মজবুত করেন।
এবারও বিএনপি সাবেক সংসদ সদস্য নাছির উদ্দিন চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, স্থানীয় নেতৃত্বের ওপর প্রভাব এবং বিস্তৃত সাংগঠনিক শক্তি তাকে পুরো মাঠে এগিয়ে রেখেছে। বয়স নিয়ে আলোচনা থাকলেও মাঠের বাস্তবতায় তিনি এখনো সবচেয়ে শক্তিশালী প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট শিশির মনির গত দেড় বছরে এলাকায় ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছেন। নম্রতা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং এলাকায় নিয়মিত অবস্থানের কারণে তিনি জনপ্রিয়তার একটি উল্লেখযোগ্য জায়গায় পৌঁছেছেন। তবে সংগঠনগত দুর্বলতা তার বড় চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রভিত্তিক স্থায়ী কর্মীসংখ্যা কম হওয়ায় নির্বাচনের দিন মাঠে তিনি তুলনামূলক পিছিয়ে থাকতে পারেন। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কিছু ভোট তার দিকে যেতে পারে তবে দল ভোটে না থাকলে ভোটারদের একটি বড় অংশ কেন্দ্রে না যাওয়ার ঝুঁকি থাকছে।
ভোটব্যাংকের হিসাব বলছে নাছির উদ্দিন চৌধুরীর পাশে রয়েছে বিএনপির স্থায়ী ভোট, ব্যক্তিগত সমর্থক এবং সুরঞ্জিতপন্থী প্রগতিশীল ভোটের একটি অংশ। শিশির মনিরের ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও সাংগঠনিক শক্তি ও ভোট আহরণের ক্ষেত্রে তিনি পিছিয়ে। নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রভিত্তিক অবস্থান ও প্রভাব উভয় দিক থেকেই বিএনপির প্রার্থী তুলনামূলকভাবে শক্ত অবস্থানে।
এদিকে আওয়ামী লীগের ঘরানার একটি অংশ সম্ভাব্য একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন দিতে পারে এমন গুঞ্জন এখন দিরাই-শাল্লার সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। যদি এমন কোনো প্রার্থী মাঠে নামেন, তবে ত্রিমুখী লড়াই তৈরি হবে, বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোট ভাগাভাগির ভেতর জামায়াতের অবস্থান আরো দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
এ আসনে প্রায় ৩ লাখ ভোটার রয়েছেন, যার মধ্যে নারী ভোটারের হার উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া হিন্দু ভোটারের সংখ্যাও বেশ বেশি, যারা সাধারণত উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও আস্থার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাদের ভোট কোন দিকে যাবে তা ফলাফলে বড় ভূমিকা রাখবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মনোনীত প্রার্থী দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা শুয়াইব আহমদ এবং খেলাফত মজলিস মনোনীত প্রার্থী মাওলানা নুরুদ্দিনও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। তবে তাদের উপস্থিতি মূল দুই প্রার্থীর ভোট সমীকরণে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
সব মিলিয়ে সাংগঠনিক শক্তি, মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ, ভোটব্যাংক এবং ব্যক্তি-ইমেজ সব সূচকেই বিএনপি প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরী এগিয়ে। তবে শিশির মনির ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ও তরুণ প্রজন্মের সমর্থনকে পুঁজি করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও তার জন্য জয় পাওয়া কঠিন চ্যালেঞ্জ, তবুও যদি তিনি সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিজয়ী হন তা হবে তার ব্যক্তিগত সক্ষমতার বড় প্রমাণ।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত জাতীয় তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৬ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মনোনয়ন জমার শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর। মনোনয়ন যাচাই-বাছাই ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি। রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের ১১ জানুয়ারি। আপিল নিষ্পত্তি ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২০ জানুয়ারি। প্রতীক বরাদ্দ ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনী প্রচার শুরু ২২ জানুয়ারি। প্রচার চলবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত।