বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

চা-বাগানে স্বামীহীন নারীদের বেঁচে থাকার লড়াই — দুঃখ, দায় আর দৈনন্দিন সংগ্রাম

সকালের কুয়াশা সরে যাওয়ার আগেই শুরু হয় তাদের দিন—হাতে ঝুড়ি, কাঁধে সংসারের বোঝা, আর মনে দুঃশ্চিন্তার পাহাড়। স্বামীহারা, পরিত্যক্তা কিংবা অল্প বয়সে বিধবা—সিলেটের চা-বাগানের হাজারো নারী প্রতিদিন সন্তানদের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে লড়ে যাচ্ছেন একা। অল্প মজুরি, সামাজিক বঞ্চনা, অনিশ্চিত আগামী—সবকিছু উপেক্ষা করে তারা যেমন পাতার ঝুড়ি ভর্তি করেন, তেমনই ভরিয়ে রাখেন সন্তানের স্বপ্ন। এই নারীদের জীবন শুধু সংগ্রামের গল্প নয়—এটি আমাদের সমাজের উপেক্ষিত বাস্তবতার এক নির্মম দলিল।

সকালের আলো ফোটার আগেই বুরজান চা-বাগানের সাবিত্রী নায়েক এর দিন শুরু হয়। আধোঘুম চোখে মেয়েদের কে স্কুলে পাঠানোর প্রস্তুতি, তারপর কাঁধে ঝুড়ি তুলে চলে যাওয়া সবুজ পাতার ভেতর। দুপুরে ঘরে ফিরেই সামান্য শুকনো ভাত আর ডাল—এই নিয়েই তার জীবনের হিসাব। 

সিলেটের চা-বাগান এলাকার ৪৫ বছর বয়সী সাবিত্রী নায়েকের জীবন থমকে যায় বছর খানেক আগে—যেদিন স্বামী বিমল নায়েক মারা যান। স্বামীর মৃত্যু শুধু শোকই আনে না, সঙ্গে নিয়ে আসে দুই মেয়েকে নিয়ে এক কণ্টকাকীর্ণ পথচলার শুরু। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে এখন প্রতিটি দিন তার কাছে নতুন লড়াই।

সাবিত্রী নায়েকের বড় মেয়ে পুষ্প নায়েক ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। মায়ের কষ্ট দেখেই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান তিনি, যাতে একদিন পরিবারকে দাঁড় করাতে পারেন। কিন্তু ছোট মেয়ে প্রমিলা নায়েকের ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। আর্থিক টানাপোড়নের কারণে এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারছেন না প্রমিলা। ভর্তি ফি, বই-খাতা ও অন্যান্য খরচ—সব মিলিয়ে যে টাকার প্রয়োজন, তা জোগাড় করার সামর্থ্য নেই সাবিত্রীর।

সিলেটের খাদিম চা-বাগানের নাজমা বেগম (৪০) প্রায় ১৬ বছর ধরে স্বামীহীন অবস্থায় দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ করে যাচ্ছেন। স্বামী নূরউদ্দিন পরিত্যাগ করে যাওয়ার পর থেকেই সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার কাঁধে। চা শ্রমিক হিসেবে অল্প মজুরিতে সংসারের খরচ, সন্তানদের পড়াশোনা ও চিকিৎসা—সব একাই সামলাতে হয় তাকে।

তার বড় মেয়ে সুমি বেগম (২০) ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। ছোট ছেলে নাজিম উদ্দীন (১৬) দশম শ্রেণিতে পড়ছে এবং পড়াশোনায় মনোযোগী। সন্তানদের শিক্ষার খরচ মেটাতে নাজমা সবসময়ই আর্থিক চাপে থাকেন, তবুও পড়াশোনা বন্ধ হতে দেননি।

নাজমা বেগম বলেন-বাচ্চাদের মানুষ করার জন্যই তিনি দিন–রাত পরিশ্রম করেন। স্বামীর অনুপস্থিতিতে একাই সংসার সামলাতে হয় তাকে। মেয়েকে ডিগ্রি পর্যন্ত পড়িয়েছেন, ছেলের পড়াশোনাও চলছে তার সংগ্রামের টাকায়। নাজমার কথায়, ওদের ভবিষ্যৎ ঠিক থাকলেই আমার সব কষ্ট সার্থক।

স্বামী পরিত্যাগের পর টানা ছয় বছর ধরে একমাত্র মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে টিকে থাকার যুদ্ধ চালাচ্ছেন দিপা তন্তুবায় (২৮)। খাদিম চা বাগান এলাকার এই নারী বর্তমানে কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। স্বামী অভিষেক তন্তুবায় কোনো খোঁজ না রাখায় সংসারের পুরো দায়িত্ব এখন দিপার কাঁধে।

অভাব-অনটনের মধ্যেও তিনি মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠানো থামাননি। তার মেয়ে তনুশ্রী, বয়স ৮ বছর, স্থানীয় বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। নিয়মিত ক্লাস করা থেকে শুরু করে পড়াশোনায় মনোযোগ—সবই চলছে মায়ের অদম্য চেষ্টায়।

স্বামী-পরিত্যক্তা নারী হিসেবে সামাজিক নানা বাধা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এবং অর্থনৈতিক সংকট—সবটাই সইতে হয় দিপাকে। তারপরও তিনি চান, মেয়েকে শিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। দিপার ভাষায়-আমি কষ্ট করবো, কিন্তু মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হতে দেবো না।

কালাগুল চা বাগানের বাসিন্দা রহিমা বেগম স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে একমাত্র মেয়েকে নিয়ে জীবন এগিয়ে নিচ্ছেন। তিনি ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। অল্প আয়ের মধ্যেও মেয়ের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করতে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।

খাদিম চা বাগানের বিধবা নারী সালমা বেগম অল্প বয়সেই স্বামী হারিয়ে তিন সন্তান—দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে কঠিন লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হন। স্বামীহীন সংসারের সব দায়িত্ব দীর্ঘদিন ধরে তিনিই বহন করে আসছেন।

শুধু সাবিত্রী, নাজমা বা দিপা নন—রহিমা বা সালমাও নন; সিলেটের চা-বাগানগুলোতে এমন আরও অগণিত নারী আছেন, সবার গল্প আলাদা হলেও লড়াই এক। স্বামীহারা বা পরিত্যক্তা হয়ে তারা পিছিয়ে পড়েননি, বরং সন্তানের ভবিষ্যৎ আঁকড়ে প্রতিদিন বাঁচার চেষ্টা করছেন।

যাদের প্রতিদিনের জীবনটাই সংগ্রামের আরেক নাম। কেউ স্বামীর পরিত্যক্তা, কেউ অল্প বয়সেই বিধবা, আবার কেউ এক সন্তানকে কোলে নিয়ে সমাজের নানা বাঁধা পেরিয়ে টিকে আছেন একা। নাম আলাদা, গল্প আলাদা—কিন্তু বেদনা ও লড়াই একই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাতার ঝুড়ি ভরেন, ঘরে ফিরে রান্না, সংসার ও সন্তানের দেখভাল করেন। অল্প মজুরি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সামাজিক চাপ—সবকিছুর মাঝেও এই নারীরা হার মানেন না।

তাদের একটাই লক্ষ্য—যত কষ্টই হোক, বাগানের এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যে থেকেও সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ না হওয়া। চা-বাগানের শ্রমিক নারীদের এই অদম্য জীবনযুদ্ধ আমাদের সমাজের অদেখা এক বাস্তবতা, যার প্রতি এখনো পর্যাপ্ত নজর পড়ে না।

এ বিষয়ে প্রত্যাশা সমাজ কল্যাণ যুব সংঘের সভাপতি সাইদুল ইসলাম সোহেল বলেন—চা-বাগানের সিঙ্গেল মায়েরা শুধু অর্থনৈতিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। তারা যে কষ্টের মধ্যে সন্তানদের মানুষ করেন, তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। সমাজের পক্ষ থেকেও তারা প্রয়োজনীয় সমর্থন পান না। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে যতটা পারি সহযোগিতা করার চেষ্টা করি, কিন্তু এ সমস্যার সমাধান স্থানীয় প্রশাসন, সমাজ ও মানবিক সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে শিক্ষা সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা ও জরুরি চিকিৎসা—এই তিনটি ক্ষেত্রে জরুরি উদ্যোগ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ বিষয়ে ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের সদস্য আতাউর রহমান শামিম বলেন—চা-বাগানের এসব সিঙ্গেল মায়েরা সত্যিই অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠী। স্বামীহীন, পরিত্যক্তা বা অল্প বয়সে বিধবা—যেভাবেই হোক, তারা একাই পরিবার চালাচ্ছেন। বাচ্চাদের পড়াশোনা, চিকিৎসা থেকে শুরু করে দিনের খাবার—সবকিছুর ভার তাদের কাঁধে। অথচ সরকারি-বে-সরকারি অনেক সুবিধা ঠিকভাবে তাদের কাছে পৌঁছায় না। আমরা চেষ্টা করি সহযোগিতা করার, কিন্তু তাদের বাস্তবতা আরও বড় ধরনের সহায়তার দাবি রাখে। বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে আলাদা উদ্যোগ খুব জরুরি।

এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন- চা-বাগানে সিঙ্গেল মায়েদের জীবনসংগ্রাম মূলত এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলা বৈষম্যের স্পষ্ট উদাহরণ। স্বামীহীন বা পরিত্যক্ত হওয়ার পর তাদের ওপর পরিবার, সমাজ ও অর্থনৈতিক সংকট—সবকিছু একসঙ্গে চাপে। এত পরিশ্রম করেও তারা মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা, মাতৃত্ব সুবিধা এবং নিরাপদ আবাসনের মতো মৌলিক সমর্থন পান না। এই নারীদের জন্য আলাদা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা এবং সন্তানের শিক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ এখন সময়ের দাবি। তাদের সংগ্রাম শুধু ব্যক্তিগত নয়—এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত অবহেলার প্রতিচ্ছবি।

এই সম্পর্কিত আরো