সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়া’ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা চরম আকার ধারণ করেছে। মন্দিরের ভূমি আত্মসাৎ ও দখলচেষ্টার অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী এবং মহানগর বিএনপির সহসভাপতি সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পুর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, আরিফুল হক চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে মন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। ফলে গত কয়েকদিন ধরে মন্দিরে পূজা-অর্চনা বন্ধ থাকায় ভক্ত ও পুণ্যার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৩ নভেম্বর মহানগর বিএনপি ও সনাতনী নেতা সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পুর নেতৃত্বে একটি দল মন্দির দখলের উদ্দেশ্যে তালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় তারা মন্দিরের সেবায়েত জিতেন চন্দ্র নাথের স্ত্রী স্মৃতি রাণী নাথ ও তার পরিবারের ওপর হামলা চালায়। হামলায় তাদের ছেলে রাহুল দেবনাথ আহত হন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হামলাকারীরা উল্টো কোতোয়ালি থানায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পুলিশ প্রথমে স্মৃতি রাণী নাথের মামলা না নেওয়ায় তারা আদালতের দ্বারস্থ হন। পরে আদালতের নির্দেশে দ্রুত বিচার আইনে ভুক্তভোগীদের মামলাটি রুজু হয়। এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই দিনের মধ্যে বিষয়টি সামাজিকভাবে নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়ে মন্দিরে তালা ঝুলিয়ে দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও তালা না খোলায় পূজা কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে মন্দিরের জমি ও অর্থ আত্মসাতের ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আখড়া পরিচালনা কমিটির কথিত নেতারা জালিয়াতির মাধ্যমে মন্দিরের প্রায় ১২ কোটি টাকার ভূমি বিক্রি এবং ১২ কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। পিবিআই এ ঘটনায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন—বিরাজ মাধব চক্রবর্তী, দিবাকর ধররাম, সুধাময় মজুমদার, শান্তনু দত্ত সন্তু, সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পু, নিতাই চন্দ্র পাল প্রমুখ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৯৫৬ সালে আখড়ার তৎকালীন সম্পাদক বিরজা মোহন দাস পুরকায়স্থ কৌশলে দেবোত্তর সম্পত্তি নিজের স্ত্রীর নামে রেকর্ড করেন। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে অবৈধ কমিটি মন্দিরের ১১.৪৪ শতাংশ জমি হস্তান্তর করে, যেখানে বর্তমানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা নিতাই পাল দল পাল্টে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। নিতাই পাল এর আগেও প্রভাব খাটিয়ে মন্দিরের জমিতে ভবন নির্মাণের চেষ্টা করেছিলেন, যা হাইকোর্টের আদেশে বন্ধ হয়। বর্তমানে পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা প্রদীপ ভট, তপন মিত্র ও শান্তনু দত্ত সন্তুর সঙ্গে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হামলার শিকার মন্দিরের সেবায়েত জিতেন চন্দ্র নাথের ছেলে রাহুল দেবনাথ বলেন, প্রশাসনিক তদন্তে টাকা ও জমি আত্মসাতের প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সুদীপ সেন বাপ্পু কীভাবে হিন্দু ধর্ম কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি হন? তিনি সদলবলে আমার পরিবারের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়েছেন। বাপ্পু মহানগর আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টায় লিপ্ত।
রাহুল আরও বলেন, এর আগে গত ৮ আগস্ট এজাজ উদ্দিন বাহিনী মন্দির দখলে তালা দিলে সেনাবাহিনী এসে তা খুলে দেয়। কিন্তু এখন আবারও তালা দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা নিতাই পালসহ অন্যরা ভুয়া কমিটির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার জায়গা বিক্রি করেছেন এবং অবৈধভাবে ভবন নির্মাণ করেছেন। আমরা এই জালিয়াতি চক্র ও সন্ত্রাসীদের বিচার চাই।
অভিযোগের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নিতাই চন্দ্র পাল বলেন, আমি মন্দিরের জায়গার ভাড়াটিয়া, কোনো ভবন তৈরি করিনি।
অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপি নেতা সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পু বলেন, অভিযোগগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। আদালত বর্তমান দখলদারদের উচ্ছেদের রায় দিয়েছে। আমরা সনাতনী নেতারা সেখানে সাধারণ সভা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু উল্টো তারা আমাদের ওপর হামলা করেছে। পুলিশ এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। নিতাই পালের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, নিতাই পালকে আমি কেবল ভাড়াটিয়া হিসেবে চিনি।
এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইরশাদুল হক বলেন, শ্রী শ্রী রাধা গোবিন্দ জিউর আখড়ার সম্পত্তি দেবোত্তর সম্পত্তি, যা ক্রয়-বিক্রয়ের এখতিয়ার কারও নেই। উপাসনালয়ে তালা ঝোলানো সাম্প্রদায়িক উস্কানির শামিল, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। প্রয়োজনে প্রশাসন সেখানে নিরাপত্তা দিতে পারে।
বিএনপি কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ্ সিদ্দিকী বলেন, মন্দিরে তালা দেয়ার বিষয়টি এখন জানলাম। আমি এই বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।
এসএমপির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, মন্দিরে তালা মারার বিষয়টি আমাদের জানা নেই। তবে দুই পক্ষের মামলা তদন্তাধীন রয়েছে।
এদিকে, মন্দিরের তালা অবিলম্বে খুলে দিয়ে পূজা চালুর দাবি জানিয়েছেন সাধারণ ভক্তরা। তারা এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম উপদেষ্টার জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।