সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
সোমবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

শিশুর পেটে শিশু: স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে চা শ্রমিক নারীরা

মাত্র ১৬ বছর ৮ মাস বয়স সুমি নায়েকের। গোলাপি সেলোয়ার–কামিজে সে এখনো এক কিশোরী, যার মুখে লাজুক হাসি আর চোখে শিশুসুলভ বিস্ময়। অথচ সেই কোমল বয়সেই কোলে তার তিন বছরের সন্তান-দৃশ্যটি যেন এক নির্মম বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এক শিশুর কোলে আরেক শিশু!

যে বয়সে পুতুল নিয়ে খেলার কথা, স্কুলে যাওয়া আর স্বপ্ন দেখা-শেখার কথা, সেই বয়সেই সুমি বুকে তুলে নিয়েছে জীবনের ভারী অধ্যায়—মাতৃত্ব। রাত জেগে শিশুর কান্না থামায়, আবার ভোরে জেগে ওঠে সংসারের কাজে যোগ দেয়। তবু তার চোখে নেই অভিযোগ, আছে এক নিঃশব্দ ক্লান্তি, আছে এক অদেখা সংগ্রামের চিহ্ন।

সিলেটের বরজান চা বাগানের বকুল নায়েকের মেয়ে সুমি নায়েক—সে যেন এই সমাজের এক নীরব প্রতিবাদ, এক জীবন্ত প্রশ্নচিহ্ন। যেখানে শৈশবকে কেড়ে নেয় দারিদ্র্য, ভাগ্য আর নিঃশব্দ অন্যায়; সেখানে সুমির মতো মেয়েরা অকালেই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠে জীবনের তিক্ত বাস্তবতায়।

তবে সুমি একা নয়। দলদলী চা বাগানের শিমলা দাস, মনিতা নায়েক কিংবা তারাপুর চা বাগানের আল্পনা, বিশখার—তাদের সবার গল্প প্রায় একই রকম। কারও কোলে শিশু, কারও কাঁধে সংসারের ভার। তারা নিজেরা এখনো কিশোরী, অথচ তাদের দিন কাটে নিজেদের সন্তানের শৈশবের স্মৃতির ছায়ায়।
এই মেয়েরা যেন এক হারানো প্রজন্মের প্রতীক—বাস্তবতা তাদের শৈশবকে গিলে খেয়েছে।
তবু তাদের চোখে নেই কোন অভিযোগ, আছে এক নিঃশব্দ ক্লান্তি, আছে এক অদেখা সংগ্রামের চিহ্ন।

এ বিষয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মনিপুর গ্রামের কিশোরী বধূ সুকুর মনি ভক্তা বলেন-আমার বয়স এখন ১৭ বছর দুই মাস। আমি দেড় বছর আগে মা হয়েছি। আমার ছেলের নাম আদিত্য ভক্তা, ওর বয়স এখন প্রায় দেড় বছর। সারাদিন ওকে নিয়েই আমার সময় কেটে যায়। ওর হাসি, ওর ছোট ছোট কথা, এগুলোর ভেতরেই আমার পুরো পৃথিবী।

তার কণ্ঠে কোনো অভিযোগ নেই, আছে নিঃশব্দ মায়া। কিন্তু সেই মায়ার আড়ালেও লুকিয়ে আছে এক কিশোরীর অকাল ক্লান্তি,যে বয়সে নিজের শৈশব উপভোগ করার কথা, সেই বয়সেই সুকুর মনি এখন নিজের সন্তানের শৈশব দেখছে চোখের সামনে।

বরজান চা বাগানের কিশোরী সিবিতা নায়েক ধীরে নিচু স্বরে বললেন-আমার বিয়ে হয়েছে মাত্র আট মাস আগে। বয়স এখন ১৬ বছর। পেটে তিন মাসের সন্তান,শরীরটা কেমন কেমন লাগে সব সময়, কিছুই খেতে পারি না, বমি আসে বারবার। কিছুই ভালো লাগে না, শুধু শুয়ে থাকলেই একটু স্বস্তি পাই।

সুকুর মনি ভক্তার মা ময়না ভক্তা বলেন-আমরা ইচ্ছে করে মেয়ের বিয়ে দেইনি, বাধ্য হয়েছি। মেয়ে  প্রেমের সম্পর্ক করে ফেলেছিল, তারপর গ্রামে কথাটা ছড়িয়ে পড়ে। তখন সমাজের চাপে, লজ্জায় আমরা তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিতে বাধ্য হই।

এ বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন-চা,বাগানে গেলে মনে হবে বাল্য বিয়ে নিরোধ আইন কেবল কাগজে সীমাবদ্ধ। খুব সম্প্রতি চা বাগানে একটি প্রগ্রামে গিয়েছিলাম নারীদের নিয়ে প্রোগ্রাম। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম খুব ই অল্প বয়সী মা যারা ছোট শিশু নিয়ে এসেছেন। তাদের কারো বয়স ১৩-১৫ এর বেশি হবে বলে মনে হলোনা। রবি ঠাকুড়ের গল্পের নায়িকা যেন।  মন কেমন করে উঠলো।

যে বয়সে মা–বাবার আদরে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সেই কোলে সন্তান নিয়ে জীবনের ভার বয়ে বেড়াচ্ছে এই কিশোরীরা। বয়সে ছোট, অথচ মুখে ক্লান্তি-যেন সময় আগেভাগেই কেড়ে নিয়েছে তাদের শৈশব। এক অপুষ্ট মায়ের কোলে এক অপুষ্ট শিশু—এটাই চা-বাগানের বাস্তবতা। শারীরিক দুর্বলতার সঙ্গে মানসিক ক্লান্তি, অবসাদ, উদ্বেগ আর পারিবারিক সহিংসতা যেন তাদের নিত্যসঙ্গী।

এ এক নীরব বঞ্চনার উপাখ্যান, যেখানে শৈশব হারায় দায়িত্বের ভারে, আর মাতৃত্ব শুরু হয় কষ্টের ভেতর দিয়ে।

এ বিষয়ে ৩নং খাদিমনগর ইউনিয়নের সদস্য আতাউর রহমান শামিম বলেন-আমরা যেখানেই বাল্যবিয়ের খবর পাই, সেখানেই প্রতিরোধের চেষ্টা করি। কিন্তু সমস্যা হলো—এখনকার প্রজন্ম খুব অল্প বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তারপর হঠাৎ করেই পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন পরিবারগুলো সামাজিক লজ্জা আর মান-সম্মানের ভয়ে বাধ্য হয়ে বিয়ে দিতে রাজি হয়। তাছাড়া এসব বিয়েতে কোনো লিখিত বা আইনি প্রক্রিয়া না থাকায় বিষয়টাকে অনেকেই সহজভাবে নেয়, আর সেখানেই তৈরি হয় সমস্যা

এ বিষয়ে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন-বাল্যগর্ভধারণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মায়ের জন্য। অল্প বয়সে শরীর সম্পূর্ণ পরিপক্ব না থাকায় মা গুরুতর জটিলতায় পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, যে শিশু জন্ম নেয়, সে অনেক সময় অপুষ্ট, অকালপ্রসূ বা কম ওজনের হয়। এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ পরবর্তীতে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে থাকে এবং নানা ধরনের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। তাছাড়া মায়ের বয়স কম থাকলে প্রসবকালীন মৃত্যুর আশঙ্কাও বেড়ে যায়।

তিনি আরও বলেন-এ সমস্যা রোধে সবচেয়ে জরুরি হলো আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পাশাপাশি বাগান এলাকার কিশোরী মেয়েদের স্বাস্থ্য শিক্ষা দিতে হবে-যাতে তারা নিজের শরীর ও জীবনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সচেতন হতে পারে।

এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন-এটা আসলেই অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়। অল্প বয়সে বিয়ের ফলে কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক-দুই ধরনের বিকাশই থমকে যায়। যে বয়সে বই-খাতা আর খেলাধুলার সঙ্গী হওয়ার কথা, সে বয়সেই তারা সংসার, সন্তান ও দায়িত্বের বোঝা টানছে-ভাবতেই কষ্ট হয়। মানসিকভাবে এখনো শিশু থাকা অবস্থায় হঠাৎ নতুন পরিবেশে, নতুন পরিবারে মানিয়ে নেওয়া তাদের জন্য এক বিশাল ধাক্কা।

তিনি আরও বলেন-এতে শারীরিক ঝুঁকি তো থেকেই যায়,অপুষ্টিতে ভোগা এসব কিশোরী মায়ের নিজের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তাদের সন্তানরাও জন্মের পর থেকেই অপুষ্টিতে ভোগে।

এই সম্পর্কিত আরো