বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
সিলেট বিভাগ

মৌলভীবাজার ১ আসন

মাঠে সরব বিএনপি, সক্রিয় জামায়াত–নতুন চমক এনসিপি ও গণঅধিকার

হাওর-পাহাড় ও চা-বাগানঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনন্য জেলা মৌলভীবাজার। এর রাজনীতির সবচেয়ে আলোচিত আসন মৌলভীবাজার-১ (বড়লেখা ও জুড়ী)। এ আসনটি গঠিত বড়লেখা উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়ন এবং জুড়ী উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে। সর্বশেষ ভোটার তালিকা অনুযায়ী মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ২৫ হাজার, যার মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার বড়লেখা উপজেলায়। রাজনৈতিকভাবে এ আসনটি সবসময়ই ছিলো আলোচনায়—কখনো আওয়ামী লীগের দুর্গ, কখনো বিএনপি ও জাতীয় পার্টির চমকপ্রদ জয়।

বিএনপির প্রার্থী নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠু মাঠে সক্রিয় —

বিএনপি ইতোমধ্যে এ আসনে দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও সাবেক সহ-সভাপতি আলহাজ্ব নাসির উদ্দিন আহমদ মিঠুকে। তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রায় ৭০ হাজার ভোট পেয়েছিলেন।দলের কঠিন সময়ে নির্বাচন করে সংগঠনটিকে টিকিয়ে রাখায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে তিনি এখন সাহসী নেতা হিসেবে পরিচিত।


বর্তমানে তিনি দিনরাত মাঠে ব্যস্ত—বিভিন্ন ইউনিয়নে গণসংযোগ, সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়, বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে তিনি ইতোমধ্যেই কয়েক দফা প্রচারণা চালিয়েছেন। তার প্রচারণায় এখন মূল স্লোগান—“আসন ফেরাতে ধানের শীষে ঐক্য চাই”।


বিএনপির ভেতরে সামান্য ভিন্নমত, ঐক্যের চেষ্টা অব্যাহত —

এদিকে বিএনপির আরেক অংশ, কাতার বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন বঞ্চিত শরিফুল হক সাজু’র অনুসারীরা এখনো মাঠে কিছুটা আলাদা অবস্থানে রয়েছেন। তারা দলীয় প্রার্থী মিঠুর আনুষ্ঠানিক প্রচারণায় না থাকলেও, নিজেদের উদ্যোগে ধানের শীষের পক্ষে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করছে। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিভাজন দূর হবে এবং নির্বাচনের আগে একক কৌশলে তারা ঐক্যবদ্ধ হবে।


জামায়াতে ইসলামী: তৃণমূলে ধীর গতির কিন্তু সক্রিয় —

এই আসনে জামায়াতে ইসলামী থেকে মাওলানা আমিনুল ইসলাম, দলের কেন্দ্রীয় নেতা, অনেক আগে থেকেই মাঠে নেমেছেন। হাট-বাজার, মসজিদ ও মহল্লা ঘুরে তিনি ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তিনি মনে করেন—“বিগত নির্বাচনে চাপের মধ্যে থেকেও জামায়াতের জনসমর্থন ছিল, এবার তা দ্বিগুণ হয়েছে।”

যদিও অতীতে জামায়াত এই আসনে একাধিকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও এখনো জয়ের মুখ দেখেনি, তবে এবার তারা বিএনপিকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে।


জাপা, খেলাফত মজলিস ও জমিয়তও ময়দানে,নির্বাচন করবে তালামীয —

জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য আহমদ রিয়াজ এ আসনে একাধিকবার নির্বাচন করেও জিততে না পারলেও প্রবাসী মহলে তার জনপ্রিয়তা রয়েছে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন—“খুব শিগগিরই আবার মাঠে নামছি।”


অন্যদিকে, খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মৌলভী লোকমান আহমদ কাতার প্রবাসী, দীর্ঘদিন প্রবাসে থেকেও এলাকায় মানবিক কাজে যুক্ত ছিলেন। এলাকায় শোডাউন ও হাট- বাজারে গণসংযোগ করেছেন ভোটারদের মাঝে। এছাড়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি মাওলানা বদরুল ইসলামও মাঠে প্রচার শুরু করেছেন, নির্বাচন করতে পারেন আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামের সাবেক সভাপতি মাওলানা বেলাল আহমদ। মূলত ধর্মীয় ভাবধারার ভোটারদের লক্ষ্য করে।


নতুন চমক এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ —

নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আলোচনায় এসেছে ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদ। এনসিপির মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন জেলা যুগ্ম-সমন্বয়কারী তামিম আহমদ ও আফজাল হোসেন, প্রবাসী নেতা জাকির চৌধুরী ও আব্দুল মালিক সাচ্চু।

দলীয় সূত্র বলছে, তামিম আহমদ মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে আছেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সিলেট মহানগর শাখার সাবেক সদস্য সচিব ছিলেন।

অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুন নূর তালুকদার ইতোমধ্যেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি এলাকাজুড়ে সভা-সেমিনারে অংশ নিয়ে তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন।

দুই নতুন দলের ক্ষেত্রেই এখন বড় প্রশ্ন—তারা কি কোনো জোটের সঙ্গে যাবে, নাকি এককভাবে লড়বে?

অতীতের নির্বাচনী ইতিহাস: আওয়ামী লীগের আধিপত্য, বিএনপির আঘাত —

স্বাধীনতার পর থেকে মৌলভীবাজার-১ আসনে বিএনপি জয় পেয়েছে দুইবার, আওয়ামী লীগ সাতবার (এর মধ্যে বিতর্কিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৩ সালের নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত), এবং জাতীয় পার্টি তিনবার।

এই আসনে বারবার চমক দেখিয়েছেন প্রয়াত প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট এবাদুর রহমান চৌধুরী, যিনি বিএনপি ও জাতীয় পার্টি উভয় দলের হয়ে চারবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সিরাজুল ইসলাম নির্বাচিত হয়ে এই আসনের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করেন।

চা বাগানঘেরা অঞ্চল হওয়ায় এখানকার চা শ্রমিক সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা বিএনপির পক্ষে গতি এনে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এইবার বিএনপি ও জামাতের মধ্য চা শ্রমিক সম্প্রদায়ের ভোট ভাগাভাগি হবার আশংকা রয়েছে। বর্তমানে বড়লেখা ও জুড়ী উপজেলায় বিএনপি, জামায়াত নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় তাদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ আসনের পাহাড়ি এলাকা ও সীমান্ত সংলগ্ন ইউনিয়নগুলোতে ধানের শীষের প্রচারণা বাড়ছে।বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জে জামাতে ইসলামির ও সভা-সমাবেশ নিয়মিত চলছে।


স্থানীয়রা বলছেন—“এই আসনে এবার ভোটের হাওয়া অন্যরকম। পুরোনো সমীকরণ বদলে যাচ্ছে।”


মৌলভীবাজার-১ আসনে বিএনপির ঐক্য, জামায়াতের সক্রিয়তা, জাতীয় পার্টির ঐতিহ্য, নতুন দলের উত্থান—সব মিলিয়ে এটি হতে যাচ্ছে সিলেট বিভাগের অন্যতম হট আসন।

বিশ্লেষকদের মতে, চা শ্রমিক ভোট, তরুণ ভোটার ও প্রবাসী জনসংযোগ—এই তিনটি ফ্যাক্টরই নির্ধারণ করবে কে এগিয়ে থাকবে শেষ মুহূর্তে।

এই সম্পর্কিত আরো