সিলেট নগর ও আশপাশের এলাকায় মশার উৎপাত আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সন্ধ্যা নামার আগেই বাসা, অফিস, দোকানপাট ও খোলা জায়গায় মশার উপদ্রবে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শহরের আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক, হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান— সর্বত্রই মশার প্রকোপ বাড়ায় জনজীবনে নেমে এসেছে চরম ভোগান্তি। এর সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার মতো প্রাণঘাতী মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ।
স্থানীয় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে উচ্চ জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, বমি ও রক্তশূন্যতায় ভুগছেন এমন রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ ও কম রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাম্প্রতিক আবহাওয়া, পানি জমে থাকা এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে এডিসসহ অন্যান্য মশার প্রজনন দ্রুত বাড়ছে। পাশাপাশি নগরবাসীর অসচেতনতা ও পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। নাগরিকদের নিজস্ব উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া মশার বিস্তার ও সংক্রমণের ঝুঁকি কমানো সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে সিলেটের বিশিষ্ট সংস্কৃতিকর্মী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন-বর্তমানে সিলেটজুড়ে মশার এমন প্রকোপ দেখা যাচ্ছে যে কোথাও নির্ভার হয়ে বসে কথা বলা বা কাজ করা যায় না। ঘর-বাহির সব জায়গায় মানুষ অতিষ্ঠ। দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শুধু ফগিং নয়, ড্রেন পরিষ্কার, জমে থাকা পানি অপসারণ এবং নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দিনের পাশাপাশি রাতে মশার উপদ্রব ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ঘরের ভেতরেও মানুষকে মশা তাড়াতে কয়েল, স্প্রে এবং ইলেকট্রিক ব্যাটের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। শহরের ড্রেন, জলাবদ্ধ এলাকা, অপরিচ্ছন্ন নালা এবং নির্মাণাধীন ভবনের ছাদে জমে থাকা পানি—সব মিলিয়ে মশার বংশবিস্তার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষ নীরব ভোগান্তিতে পড়েছেন, বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের রাতে ঘুমেও ব্যাঘাত হচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান ছাড়া শহরে মশার প্রকোপ কমানো কঠিন। জরুরি পদক্ষেপ না নিলে সামনের দিনগুলোতে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণ আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (ত্বক ও যৌনরোগ) ডা. ফারজানা ইয়াসমিন সুমা বলেন-গত কয়েক সপ্তাহে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে। সমস্যা হলো অনেক রোগী দেরিতে চিকিৎসা নিতে আসছেন, যার ফলে জটিলতা এবং রোগের প্রভাব আরও বাড়ছে। এছাড়া এমন কিছু রোগীও আছে যাদের গায়ে মশার কামড়ের স্থানগুলোতে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে এবং এলার্জির সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই সময়মতো সতর্কতা অবলম্বন এবং প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।
এ বিষয়ে সিলেট এম.এ.জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী বলেন-বর্তমানে সিলেটে মশার প্রকোপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়ার সংক্রমণও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সময়মতো সতর্কতা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে স্বাস্থ্যঝুঁকি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে ঘর-বাড়ি ও আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিতে হবে এবং সমস্যা দেখা মাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এ বিষয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন-আমরা গত সপ্তাহ থেকে শহরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মশার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কীটনাশক ছিটানো কার্যক্রম শুরু করেছি। তবে সমস্যার বিষয় হলো জনবল খুবই সীমিত। পর্যাপ্ত মানুষ না থাকায় এবং পারিশ্রমিক দিয়েও জনশক্তি সংগ্রহে সমস্যা থাকায় কাজটি ধীর গতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। সঠিক ও কার্যকর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত জনবল ও সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)–এর সিলেট বিভাগের সমন্বয়কারী ডা. সুফী মুহাম্মদ খালিদ বলেন- সম্প্রতি সিলেট শহরে মশার উপদ্রব উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, যা জনগণের স্বাস্থ্য ও জনজীবনের জন্য উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করছে।
মশা-বাহিত রোগ যেমন ডেংগু, চিকুনগুনিয়া ভাইরাস থেকে সুরক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা। তাই আমরা নাগরিকদের আহ্বান জানাচ্ছি— প্রতি সপ্তাহে একবার করে নিজের ঘর ও আশপাশ পরিষ্কার করুন, ফুলের টব, পুরনো টায়ার, ড্রাম, পাত্রে জমে থাকা পানি ফেলে দিন, জানালা ও দরজায় মশারি বা জালি ব্যবহার করুন এবং প্রয়োজন হলে বাহিরে যাওয়ার সময় মশা নিরোধক লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করুন। নিজে সচেতন হোন, পরিবার ও প্রতিবেশীকে সচেতন করুন। মশামুক্ত সিলেট, সুস্থ সিলেট গড়াই আমাদের লক্ষ্য।
এ বিষয়ে সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন-সিলেটে মশার উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্কবার্তা। আশপাশে মশাবাহিত রোগের সংক্রমণও বাড়ছে, তাই এখনই সবাইকে আরও সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। ডেংগু প্রতিরোধের সর্বোত্তম উপায় হলো নিজস্ব পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়ি ও আশপাশে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা, ড্রেন ও ফুলের টবে পানি না জমতে দেওয়া এবং মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করা প্রয়োজন। নাগরিক সচেতনতা ও প্রশাসনিক উদ্যোগ একসঙ্গে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সিলেটে বাড়তে থাকা মশার উপদ্রব ও ডেংগু ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।