সিলেটে এখনো মানসিক রোগকে অনেকে চিকিৎসাযোগ্য সমস্যা হিসেবে নয়, বরং ভুতের আছর বা জিনের প্রভাব হিসেবে দেখেন। রোগীর আচরণ একটু অস্বাভাবিক হলেই তাকে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়া হয় ওঝা, কবিরাজ বা ফকির-মৌলভীর দরবারে। সেখানে তাবিজ-কবজ, পানি পড়া, ঝাড়ফুঁক বা কখনও শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে চলে তথাকথিত চিকিৎসা। এই প্রক্রিয়ায় মানসিক রোগীরা যেমন ভয় ও যন্ত্রণার মধ্যে পড়েন, তেমনি সময়মতো চিকিৎসা না পেয়ে তাদের অবস্থা আরও অবনতি ঘটে। ফলে সহজে নিরাময়যোগ্য মানসিক অসুস্থতা পরিণত হয় জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী সমস্যায়, যা শেষ পর্যন্ত রোগীর পরিবার ও সমাজ উভয়ের জন্যই হয়ে ওঠে এক গভীর মানবিক সংকট।
সিলেট শহর ও আশপাশের গ্রামাঞ্চলে মানসিক রোগ নিয়ে এখনো রয়েছে গভীর কুসংস্কার ও অজ্ঞতা। কেউ মনমরা বা নীরব থাকলে বলা হয় জিন ধরেছে, কেউ বেশি চিন্তিত বা হতাশ থাকলে ধরে নেওয়া হয় ভুতের আছর। ধর্মীয় ব্যাখ্যা আর অলৌকিক বিশ্বাসের মাধ্যমে মানসিক সমস্যার সমাধান খোঁজার এই প্রবণতা আজও অনেক পরিবারে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। ফলস্বরূপ, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতার অভাব, চিকিৎসার প্রতি অবিশ্বাস এবং সামাজিক লজ্জার ভয়— সব মিলিয়ে রোগীরা থেকে যাচ্ছেন অবহেলিত ও অসহায়। এটি শুধু ব্যক্তির নয়, পুরো সমাজের মানসিক সুস্থতার জন্যও এক গভীর বিপদের ইঙ্গিত বহন করছে।
এ বিষয়ে সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা গোলাপগঞ্জ উপজেলার রুবিনা বেগম বলেন—আমার মেয়ে কিছুদিন ধরে একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল, কারও সঙ্গে কথা বলত না, একা একা থাকত। আশপাশের অনেকে বলল— ওর ওপর নাকি জিন ধরেছে। ভয়ে আমরা ওঝার কাছে যাই, ঝাড়ফুঁকও করানো হয়, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি, বরং মেয়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। পরে ওসমানী হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি জানান, ও আসলে মানসিক চাপে ভুগছে। নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধের পর এখন অনেকটাই সুস্থ, আগের মতো হাসে, কথা বলে, এমনকি পড়াশোনাও শুরু করেছে।
রুবিনার অভিজ্ঞতা একা নয়— সিলেটের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই এমন অগণিত পরিবারের গল্প শোনা যায়। কুসংস্কার, ভয় আর অজ্ঞতার কারণে মানসিক রোগকে এখনো অনেকে অলৌকিক সমস্যা ভেবে ভুল পথে হাঁটছেন। ফলে মানসিক রোগীরা যেমন সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি সমাজেও গড়ে উঠছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভয় ও বিভ্রান্তির এক গভীর দেয়াল।
কিছু দিন আগে সিলেট নগরীর ৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. মইন মিয়া (ছদ্মনাম) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি দীর্ঘদিন ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
শুধু মইন মিয়া নন মানসিক অস্থিরতা, হতাশা ও অবসাদের কারণে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সামাজিক কুসংস্কার, চিকিৎসার প্রতি অনীহা এবং সমস্যাকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এই মৃত্যুগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে, যা এখন সমাজের জন্য এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে এম. এ. জি. ওসমানী মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আহমেদ রিয়াদ চৌধুরী বলেন—মানসিক বা মনের রোগ আসলে সম্পূর্ণভাবে মস্তিষ্কনির্ভর। আমাদের ব্রেইনই শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিটি দিক এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ বা অলৌকিক উপায়ে মানসিক রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করা একেবারেই কুসংস্কার। এতে রোগের উন্নতি তো হয়ই না, বরং সময় নষ্ট ও ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত, কারণ সঠিক চিকিৎসা ও সহানুভূতিপূর্ণ মানসিক সহায়তাই এই রোগ নিরাময়ের মূল চাবিকাঠি।
এই সমস্যা নিরসনে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী ডা. সুফী মুহাম্মদ খালিদ বলেন—মানসিক স্বাস্থ্য আজ বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বাংলাদেশ সরকারকে এই খাতে নীতিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে, যাতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া যায়। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে আমরা টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে মানসিক রোগীদের নিয়মিত চিকিৎসা ও পরামর্শ সেবা চালু করেছি। মানুষ যেন কুসংস্কার নয়, চিকিৎসার প্রতি আস্থা রাখে, এ নিয়ে আমরা সচেতনতা বাড়ানোরও কাজ করছি। মানসিক রোগ কোনো অভিশাপ নয়, বরং এটি সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনই পারে মানসিক স্বাস্থ্যকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে।
এ বিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (ঢাকা)-এর সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন—শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বহু দেশেই মানসিক স্বাস্থ্য এখনো উপেক্ষিত একটি বাস্তবতা। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বের প্রায় ২০% মানুষ কোনো না কোনোভাবে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশায় ভুগছেন। এছাড়াও ১% মানুষ গুরুতর মানসিক রোগে ভুগছেন। এই সকল রোগীদের ৯২ শতাংশ মানসিক চিকিৎসা গ্রহণ করেন না। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, মানুষ এখনও এই বিষয়টিকে কুসংস্কার, লজ্জা বা দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখে। ফলে অনেকেই সময়মতো চিকিৎসা নিতে দ্বিধা বোধ করেন, যা তাদের অবস্থাকে আরও জটিল করে তোলে, কখনও কখনও চরম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়।
অথচ মানসিক রোগও অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই চিকিৎসাযোগ্য। সময়মতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ, নিয়মিত চিকিৎসা, পরিবারের মানবিক সহায়তা এবং সমাজের ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতা থাকলে একজন মানুষ খুব সহজেই সুস্থ, স্বাভাবিক ও পূর্ণাঙ্গ জীবন ফিরে পেতে পারেন। সচেতনতা বাড়ানো এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে স্বাভাবিক জীবনের অংশ হিসেবে মানা একান্ত প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন— মানুষ এখনও মানসিক রোগকে ভুলভাবে পাগলাম’ বা অশরীরী প্রভাব হিসেবে দেখে। অনেকেই ভুতের আছর বা জিনের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ভাবেন। ফলস্বরূপ, মানসিক অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালের চিকিৎসার পরিবর্তে ওঝা, কবিরাজ বা ফকির-মৌলভীর কাছে নেওয়া হয়। সেখানে তাবিজ-কবজ, পানি পড়া বা শারীরিক নিপীড়নের মাধ্যমে চিকিৎসার ছদ্মবেশে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। অথচ মানসিক রোগও ঠিক অন্যান্য শারীরিক রোগের মতোই সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও আরোগ্য সম্ভব। সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগীর অবস্থা আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যেতে পারে, তাই পরিবারের সচেতনতা ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর ও নিরাপদ সমাধান।