সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউনিয়নের প্রতাপপুর গ্রামের বেড়ীবাঁধে মাদকের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযান চালায় মার্কুলি নৌ-পুলিশ। মার্কুলি নৌ-পুলিশের দায়িত্বে থাকা ইন্সপেক্টর কাওসার গাজী ওরফে আব্দুর রহমানের নির্দেশে সেই অভিযানটি চালায় নৌ-পুলিশের একটি টিম। প্রায় ২'শ লিটার চোলাই মদ, তিনটি মোটরসাইকেল সহ শাল্লা উপজেলার মৌরাপুর গ্রামের পাপন সরকার (২২) নামের এক মাদক বিক্রেতাকে গ্রেফতারও করা হয়। গ্রেফতার করার পর পরই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ছেড়ে দেওয়ার পায়তারা চালায় নৌ-পুলিশের ইন্সপেক্টর কাওসার গাজী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নির্ধারিত সীমানার বাহিরে গিয়ে শাল্লা উপজেলার প্রতাপপুর গ্রামের পাশে অভিযান চালায় হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার অধীনস্থ মার্কুলি নৌ-পুলিশ। অভিযানে তিনটি মোটরসাইকেল আটক করা হলেও আর্থিক লেনদেনের সুযোগ তৈরি করার উদ্দেশ্য গাড়িগুলো জব্দ তালিকায় না তুলে গাড়িগুলো উধাও করে ফেলেন পুলিশ। চোলাই মদ পরিবহনে থাকা গাড়িগুলো জব্দ তালিকায় না তোলায় স্থানীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এতে শাল্লা উপজেলা ছাড়াও আজমিরীগঞ্জের পাহাড়পুর ও বানিয়াচং উপজেলা জোড়ে এক বিশাল তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এবং তোলপাড় সৃষ্টি করা এই কান্ডে মার্কুলি নৌ-পুলিশের ইনস্পেক্টর কাওসার গাজী ছাড়াও এস আই রুকুনুজ্জামান, এস আই সুরুজ আলী ও কনস্টেবল নাছির হোসেন সরাসরি জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
শুধু তাই নয়, মামলার নথিপত্র ঘেঁটে দেখা জানা গেছে, আাসামিদের নিকট হতে ২'শ লিটার চোলাই মদ আটক করা হলেও মামলায় দেখানো হয়েছে মাত্র ৪৮ লিটার। বাকি ১৫২ লিটার মদ পাহাড়পুরের একজন মাদক ব্যবসায়ির কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পরে ওই ব্যবসায়ি মাদগুলো সেখানকার একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে বিক্রি করে দেয়। জানা গেছে, জব্দকৃত ২শ' লিটার মদের সাথে শাল্লা উপজেলার বিলপুর গ্রামের মন্টু দাসের ছেলে সুহেল দাস (২০) সহ অন্তত আরো পাঁচজন মাদক বিক্রেতা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও অদৃশ্য কোন এক কারনে মামলার এজাহারে তাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। অনুসন্ধানে পাওয়া এসব তথ্যের সপক্ষে সবধরনের প্রামাণ ও কল রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে এবং তা সংরক্ষণে রাখা হয়েছে।
তথ্যানুসন্ধান বলছে, মাদক বিক্রেতাদের পালাতে সহযোগিতা করেছেন নৌ-পুলিশ নিজেই। এবিষয়ে সরেজমিনে কথা হয় মামলার ১ নং সাক্ষী বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা চন্দ্র কান্ত বৈষ্ণবের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, চারটি বস্তায় প্রায় দুইশো লিটার মদ সহ তিনটি মোটরসাইকেল আটক করে মার্কুলি নৌ-পুলিশ। তিনি জানান, দুইটি মোটরসাইকেল চালিয়ে নৌ-পুলিশ মার্কুলি ফাঁড়ি থানাতে নিয়ে যায়। একটি মোটরসাইকেল নৌকায় তুলে নেওয়া হয়েছে। এই প্রতিবেদককে মামলার ২য় সাক্ষী হৃদয় বৈষ্ণবও একই কথা জানান। দুজন সাক্ষীর ভাষ্য নিয়ে মামলার আরেক সাক্ষী নৌ-পুলিশের কনস্টেবল নাছির হোসেনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনকিছু না জেনেই তার স্যারের নির্দেশে মামলায় সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন বলে জানান।
মদের সঠিক পরিমাণ জানতে অনুসন্ধান করে বের করে কথা হয় নৌ-পুলিশের সহযোগিতায় পালিয়ে আসা মাদক বিক্রেতাদের সাথে। তাদের সাথে সরাসরি কথা বলে এই প্রতিবেদক। সঙ্গতকারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু'জন মাদক বিক্রেতা জানান, চারটি বস্তায় তাদের দুইশো লিটার মদ ছিল। ৪৮ লিটার মদ ছাড়া বাকি মদগুলো বিক্রি করে দিয়েছে নৌ-পুলিশ। তারা বলেন, আমাদের মদ, মোটরসাইকেল ও একজন লোককে ছেড়ে দিবে বলে শুরুতেই তাদের কাছে দু-লক্ষ টাকা দাবি করে আসছিলেন নৌ-পুলিশের ইন্সপেক্টর কাওসার গাজী ও এস আই রুকুনুজ্জামান। পুলিশকে পয়ষট্টি হাজার টাকা দিবে বললেও তাদের মালামাল ছাড়েনি। পরবর্তীতে তাদের কাছে দেড় লক্ষ টাকা দাবি করেন পুলিশ। মাদকবিক্রেতারা আশি হাজার টাকায় রাজি হলেও কম হওয়ায় তাদের মালামাল ছাড়া হয়নি। একপর্যায়ে তারা (মাদকবিক্রেতারা) জানান, সাংবাদিকদের ভয়ে তাদের গাড়ি ধরা হয়নি বলে পুলিশ তাদেরকে জানায়। মাদকবিক্রেতারা জানান ওই ঘটনায় তাদের (নৌ-পুলিশদের) চাকরি নিয়ে টানাটানি। নৌ-পুলিশের কনস্টেবল নাছির হোসেন সহ অন্যান্যদের সাথে তাদের খুব সম্পর্ক রয়েছে বলে জানান তারা।
এদিকে জব্দ তালিকায় না তোলা তিনটি মোটরসাইকেল সরেজমিনে গিয়ে মার্কুলি ফাঁড়ি থানায় দেখা যায় নি। সেখানকার স্থানীয়দের সাথে কথা হলে তারা জানান, জব্দ না করায় গাড়িগুলো থানায় রাখা হয়নি। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিশ্বস্ত কয়েকটি সূত্র জানিয়েছেন গাড়িগুলো মার্কুলি বাজারের কোথাও একটি গুদামে রাখা হয়েছে।
মার্কুলি নৌ-পুলিশের ইন্সপেক্টর কাওসার গাজীর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করে ২০০ লিটার মদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘পলিথিনে কতখানি ছিল জানি না। মাঝপথে নদীতে এসে মনে হয় একটা পলিথিন ছিড়ে গেছিল। পরে কতটুকু কি ছিল, না ছিল তা জানি না।’ মোটরসাইকেল কয়টা আটক করে কোথায় রাখা হয়েছে? এ প্রশ্নে তিনি ‘কিসের মোটরসাইকেল?’ বলে উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়েন। এসব কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি এ প্রতিবেদককে থানায় গিয়ে চা খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘কিছু জানি এবং সবই বুঝি। থানায় আইসেন।’ তবে ‘সবই বুঝি’ কথার বিস্তারিত ব্যাখ্যা কী-জানতে চাইলে তিনি আর কোনো কথা বলেননি। তারপর এবিষয়ে সরাসরি সাক্ষাৎকার নিতে গত ২৪ অক্টোবর শুক্রবার মার্কুলি নৌ-ফাঁড়ি থানায় সরেজমিনে গেলে মার্কুলি নৌ-ফাঁড়ি পুলিশের ইন্সপেক্টর কাওসার গাজী বলেন, ‘মিডিয়ায় কথা বলা যাবে না, এটা আইজিপি ও ডিআইজির নির্দেশ! এরপর এই প্রতিবেদককে অফিসে রেখেই ইন্সপেক্টর অফিস ত্যাগ করে চলে যায়।
কথা হয় জব্দ তালিকা প্রস্তুতকারী এস আই রুকুনুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা কোন মোটরসাইকেল আটক করিনি। শুধু ৪৮ লিটার মদ আটক করে জব্দ করা হয়েছে বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে দেন।’ এ বিষয়ে শাল্লা থানা পুলিশ কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করেন। বিষয়টি অন্য ইউনিটের হওয়ায় এবিষয়ে কোন মন্তব্য করতে নারাজ শাল্লা থানা পুলিশ।
নৌ পুলিশের মাদক আটককাণ্ডের বিষয়ে নৌ-পুলিশের সিলেট রেঞ্জের পুলিশ সুপার ফাল্গুনী পুরকায়স্থের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আপনি রিপোর্ট করেন বিষয়টি দেখে আমি ব্যবস্থা নেবো।