সীমান্তবর্তী সিলেট সবসময়ই চোরাচালানের ঝুঁকিতে ছিল। এখন সেই ঝুঁকি বেড়েছে কুরিয়ার সার্ভিসকে কেন্দ্র করে। সাধারণ পার্সেলের মোড়কে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাদক ও অবৈধ পণ্যের চালান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক অভিযানে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
অভিযোগ উঠেছে এসব কর্মকাণ্ড কুরিয়ার সার্ভিসের কিছু অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে হচ্ছে, আবার অনেক সময় চোরাকারবারিরা পার্সেলের নাম করে পণ্য পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সব মিলিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো এখন পাচারকারীদের জন্য একটি ‘নিরাপদ রুট’ হয়ে উঠেছে। নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও পাচারের ধরণ এতটাই কৌশলী হয়ে উঠেছে যে, তা সনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
গত মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাত ২টার দিকে কানাইঘাট থানার পুলিশ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একটি কাভার্ডভ্যান থেকে ৮০ বস্তা ভারতীয় চা-পাতা (প্রায় ৪ হাজার কেজি) জব্দ করে। কাভার্ডভ্যানচালক বিশ্বনাথ উপজেলার হাওরাবাজার এলাকার মৃত নাইম উদ্দিনের ছেলে মাসুম মিয়াকে (২৬) আটক করা হয়। উদ্ধারকৃত চা-পাতার বাজারমূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা।
এর আগেও, ৩০ জুলাই সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের সামনে অভিযান চালিয়ে তিন মাদক চোরাকারবারিকে আটক করে র্যাব-৯। তারা বাচ্চাদের পায়জামা ও আন্ডারওয়্যারের ভেতরে ২০০ বোতল ফেনসিডিল লুকিয়ে পাঠানোর চেষ্টা করছিল।
১৮ সেপ্টেম্বর হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে গাঁজা পাঠাতে গিয়ে এক মাদক কারবারিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
আর ১৭ সেপ্টেম্বর সিলেট নগরের নাইওরপুল এলাকার এসএ পরিবহণের অফিসে অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনী ও বিজিবি যৌথ টাস্কফোর্স বিপুল পরিমাণ ভারতীয় শাড়ি, কম্বল, স্কিন ব্রাইট ক্রিম ও নিভিয়া বডি লোশন জব্দ করে। অভিযানের পর থেকে ওই অফিসে তালা ঝুলছে, এবং স্টাফরাও উধাও।
সূত্র জানায়, মাদকের চালান পাঠানোর ক্ষেত্রে চোরাকারবারিরা এখন নানা কৌশল অবলম্বন করছে। কখনও টেলিভিশন, ল্যাপটপ কিংবা পোশাকের ভেতরে লুকিয়ে ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজা পাঠানো হচ্ছে। পার্সেল প্রেরকদের দেওয়া নাম-ঠিকানাগুলো প্রায়ই ভুয়া থাকে। এমনকি মোবাইল ফোনের সূত্র ধরে খুঁজেও তাদের সনাক্ত করা যায় না। ফলে প্রাপক ধরা পড়লেও প্রেরক অধিকাংশ সময় থেকেই যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
র্যাব-৯ এর অতিঃ পুলিশ সুপার (মিডিয়া অফিসার) কে. এম. শহিদুল ইসলাম সোহাগ, “বিষয়টি নিয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো আন্তরিক হলে এই রুটে মাদক পাচার অনেকটাই বন্ধ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, “কুরিয়ার সার্ভিসগুলোর প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। যাতে করে কেউ এই সুযোগ নিতে না পারে।”
বিশ্লেষকদের মতে, কুরিয়ার সার্ভিসের তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল হওয়ায় পাচারকারীরা সহজেই এই রুট ব্যবহার করছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পার্সেল স্ক্যানিং বা শনাক্তকরণের আধুনিক ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া প্রেরক-প্রাপক যাচাইয়ের কোনো বাধ্যতামূলক পদ্ধতি না থাকায় চোরাকারবারিদের পক্ষে এ পথটি “ঝুঁকিমুক্ত” হয়ে উঠছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরামর্শ— প্রতিটি কুরিয়ার পার্সেলের প্রেরক ও প্রাপকের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই বাধ্যতামূলক করা, সন্দেহভাজন পার্সেলে এক্স-রে বা স্ক্যানিং প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং প্রতিটি পার্সেল ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা।
এছাড়া কুরিয়ার কোম্পানির এজেন্ট ও কর্মীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং স্থানীয় প্রশাসন, র্যাব, বিজিবি ও কাস্টমসের সমন্বিত নজরদারি টাস্কফোর্স গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।