দেখতে দেখতে দুই দশকের দোরে পৌঁছে গেছেন মেসি। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে (২০০৬ বিশ্বকাপ) পেরুর বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে দেশের মাটিতে লিওনেল মেসির যাত্রা শুরু হয়েছিল। আর বাংলাদেশ সময় কাল ভোরে আরও একটা বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে মেসি খেলতে নামছেন; না, শুধু খেলতে নামছেন বললেই শেষ হয়ে যায় না এই ম্যাচের গুরুত্বের কথা।
দেশের মাটিতে সম্ভাব্য শেষ ম্যাচ হতে যাচ্ছে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে এই ম্যাচ। এই দুই দশকের মধ্যে মেসি আর্জেন্টিনাকে সম্ভাব্য সব শিরোপা জিতিয়েছেন। নিজে সর্বোচ্চ ম্যাচ (১৯৩ ম্যাচ) খেলেছেন, সর্বোচ্চ গোলদাতা (১১২ গোল) হয়েছেন, হ্যাটট্রিক করেছেন (১০টা) করেছেন গোলে সহায়তার (৬১ এসিস্ট) রেকর্ড। ইউরোপের স্পেনের পরে প্রথম লাতিন দল হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেবল (কোপা-বিশ্বকাপ-কোপা) জিতিয়েছেন আর্জেন্টিনাকে।
এইসবের সাথে মেসি ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ (৪৬) শিরোপাজয়ী ফুটবলার, সর্বোচ্চ ব্যলন ডি অর জয়ী ফুটবলার, ফিফার বর্ষসেরা হয়েছেন সর্বোচ্চ (৮) বার। সাথে আন্তর্জাতিক ফুটবল ও ক্লাব ফুটবলের ভুরিভুরি রেকর্ড তো আছেই। মেসির রেকর্ডের হিসব না কষে ফুটবলের রেকর্ড শব্দটাকে ‘মেসি’ বলে অভিহিত করা যায়। কারণ শয়ে-শয়ে রেকর্ডের ভাণ্ডার থেকে বাছাই করলেও অগণিত রেকর্ড আছে লিওনেল মেসির।
বাছাইপর্বের ম্যাচে শুরু হয়ে শেষও হতে যাচ্ছে বাছাইপর্বের ম্যাচ দিয়ে। লাতিন আমেরিকান বাছাইপর্বে ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ম্যাচের মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ফুটবলার হতে যাচ্ছেন মেসি তাছাড়া সর্বোচ্চ গোলদাতা (৩৪ গোল) মেসি।লাতিন আমেরিকান প্রতিটা দলের বিপক্ষে গোলের রেকর্ডও মেসির। ২০১০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে শুরু করে ২০২৬ পর্যন্ত বিশ্বকাপ বাছাইয়েও সর্বোচ্চ গোলদাতার নামও মেসি। চলমান বাছাইয়েও মেসির গোল ৬টা, যেখানে লুইস দিয়াজ ৭ গোল করে শীর্ষে আছে। বাকি দুই ম্যাচে দিয়াজের চেয়ে এক গোল বেশি করলেও মেসি সেখানেও প্রথম হবেন! এই যখন সমীকরণ, সেখানে মনুমেন্তালে মেসির চক্রপূরণের দিকে চোখ বিশ্বব্যপী অযুত-নিযুত ফুটবল-অনুরাগীর। মেসি নিজেই বলেছেন-তার পরিবার উপস্থিত থাকবে। (সম্ভাব্য) দেশের মাটিতে শেষ ম্যাচ উপলক্ষে আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনও নানা উদ্যোগ নিয়েছে। ম্যাচ পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে কোচ লায়োনেল স্কালোনি আবেগে ভেসেছেন, আবেগে ভাসিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই মেসির শেষ ম্যাচ স্টেডিয়ামে বসে প্রায় লাখ খানের দর্শক উপভোগ করবে। আর বিশ্বব্যপী সেই মুহুর্তের স্বাক্ষী হবে অগণিত ফুটবল-অনুরাগী। সবাই প্রত্যক্ষ করবে ওয়ান লাস্ট ড্যান্স অফ দ্য গ্রেটেস্ট এভার ফুটবলার!
অথচ মেসির জাতীয় দলের ক্যারিয়ার ২০২১ কোপা আমেরিকা পর্যন্ত ছিলো তীরে এসে তরী ডুবানোর গল্প। একের পর এক ফাইনাল হার বিষিয়ে তুলেছিল মেসিকে। সিনিয়র দলের হয়ে শিরোপা না জিতলেও ক্লাবের হয়ে একের পর এক শিরোপা জেতা উসকে দিয়েছিল মেসির নিবেদনকে! সেই রাগ ও ক্ষোভ সংবরণ করতে না পেরে একবার তো অবসরই নিয়ে ফেলেছিলেন। সেখান থেকে সমর্থকদের কাকুতি-মিনতিতে ফিরে এসে একের পর এক সব শিরোপা জিতেছেন।
মেসি ফুটবলের নিখাদ এক চরিত্র। হাল না ছাড়া রাজপুত্র। স্বপ্নের মত শুরু হয়ে খেই হারিয়ে ফেলা এবং শেষটা সম্ভাব্য সব সাফল্যে রাঙ্গিয়ে দেওয়া...এ যেন রূপকথার ফুটপুত্র। ফুটবলের সুদীর্ঘ ইতিহাসে পরিসংখ্যানের মাপকাটিতে দ্বিতীয় মেসি আসবে না।
সাফল্যে আর ফুটবলকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মেরুকরণে মেসিই অনন্য, অসাধারণ এবং অবিশ্বাস্য। কিন্তু সবকিছুর শেষ আছে। একটা সময় এসে বিদায় নিতে হয়। কালকের ম্যাচ দিয়ে মেসির বিদায় পর্ব শুরু হচ্ছে। ভেনেজুয়েলার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে দেশের মাটিতে বিদায় বলে দিচ্ছেন লিওনেল গ্রেটেস্ট মেসি। এভাবে ছোট-ছোট বিদায় শেষে আর অতি অল্প দিন পরে একেবারে বিদায় বলে দিবেন। আমেরিকা বিশ্বকাপ শেষে জাতীয় দলকে বিদায় বলে দিবেন, তারপর ইন্টার মিয়ামির হয়ে ক্লাব ফুটবলকে বিদায় বলে দিবেন। এভাবেই একটা বিরল নক্ষত্রের বিদায় আমরা প্রত্যক্ষ করবো। কিন্তু আমরা ভেবেছিলাম মেসি হয়তোবা বিদায় নিবে না। আজীবন খেলেই যাবে। আমরা তাঁর ফুটজাদুতে এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছি যে, তাঁরও যে একদিন বিদায় নিতে হবে আর আমাদের বিদায় দিতে হবে, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। কালকের ম্যাচের পর থেকে আমাদের মাথায় সেটা সেট করে দিতে যাচ্ছে মেসি। বিদায়ের রাগিণী বাজতে শুরু করেছে...আর বেশিদিন নেই!
রূপসী বাংলার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ মেসির উদ্দ্যেশে লিখেননি এই লাইনটা। কিন্তু সেটা মেসির মত আর কাকে এভাবে মানায়-এই পৃথিবী একবার পায় তারে...
শুভ বিদায় দ্য গোট ।
সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা এবং অভিবাদন।