বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
বিশেষ প্রতিবেদন

আড়ালে অস্ত্র ও মাদক পাচার

‘আমি বিজিবির ডালিম বলছি, টাকা নিয়ে ভিডিও ডিলিট করুন’

সিলেটের পর্যটন কেন্দ্র জাফলং এখন আর কেবল পর্যটনের জন্য নয়, বরং প্রশাসনের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার ‘ছত্রছায়ায়’ অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। সীমান্তবর্তী এই জনপদে বালি লুটপাট, ভারতীয় পণ্যের মহোৎসব এবং মরণঘাতী অস্ত্র ও মাদকের ভয়াবহ কারবার চলছে। এই সিন্ডিকেটের নেপথ্যে রয়েছেন স্থানীয় ৩নং পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল মন্নান (মন্নান মেম্বার) এবং তার সহযোগী, বিজিবির ‘লাইনম্যান’ হিসেবে পরিচিত ডালিম। অভিযোগ উঠেছে, এই সিন্ডিকেট ভারত থেকে অবৈধভাবে অস্ত্র নিয়ে আসছে এবং তা নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের কাছে সরবরাহ করছে।


গত ২৩ ডিসেম্বর (মঙ্গলবার) সরজমিন অনুসন্ধানে নামে ‘দৈনিক সবুজ সিলেট’ টিম। গোয়াইনঘাট সদর থেকে জাফলং পর্যন্ত সড়কে দেখা যায় আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতির চিত্র। দিনদুপুরেই পুলিশের চেকপোস্টের সামনে দিয়ে ডিআই ট্রাক ভর্তি ভারতীয় মহিষ এবং শত শত নম্বরবিহীন মোটরসাইকেলে পাচার হচ্ছে জিরা, কসমেটিকস ও কম্বল। ১৫-১৭ বছরের কিশোরদের দিয়ে চালানো এসব মোটরসাইকেলে অন্তত ৫ বস্তা করে জিরা বহন করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে দিয়েই এসব অবৈধ পণ্য নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে।
রাত আড়াইটার দিকে মোহাম্মদপুর-জাফলং বাইপাস রোডে জিরাবাহী মোটরসাইকেল চালকদের গতিরোধ করলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। চালকরা জানান, প্রতি ট্রিপে এক হাজার টাকার বিনিময়ে তারা পণ্যগুলো রাধানগরের গুদামে পৌঁছে দেন। বাধা দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে চালকরা জানান, “মন্নান মেম্বার ও ডালিম সবকিছু ম্যানেজ করেন; পুলিশ, বিজিবি ও ডিবি—কাউকেই আমাদের ভয় নেই।”


অনুসন্ধানকালে জাফলং সংগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি রহস্যজনক আচরণ করেন। বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই দেখা যায় চোরাকারবারীদের জটলা। এমনকি বিজিবি সদস্যদের জব্দ করার কথা বলা মালামাল এক বহিরাগত ব্যক্তিকে দিয়ে ক্যাম্পে পাঠাতে দেখা যায়। এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে ক্যাম্প কমান্ডার উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং নিজেকে অসুস্থ দাবি করেন। এর কিছুক্ষণ পরই এক বিজিবি সদস্য হোয়াটসঅ্যাপে অডিও বার্তা পাঠিয়ে কমান্ডারের পক্ষে ক্ষমা চান।


এর পরপরই ‘বিজিবির লাইনম্যান’ ডালিম অনুসন্ধানী টিমের এক সদস্যকে ফোন দিয়ে হুমকির সুরে বলেন, “আপনারা সংগ্রাম ক্যাম্পের কমান্ডারের সাথে ঝামেলা করলেন কেন?” প্রথমে নিজেকে বিজিবির লোক পরিচয় দিলেও পরে তিনি স্বীকার করেন, “ভাই আমি আর মন্নান মেম্বার এই লাইন (চোরাচালান) চালাই। আপনারা ভিডিওগুলো কেটে দেন, আমাদের পেটে লাথি দিয়েন না। টাকা-পয়সা দিয়ে সেটেল্ড করি।” ডালিম আরও দম্ভ করে বলেন, সংবাদ প্রকাশ করে তাদের কিছুই করা যাবে না।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরাচালানের পণ্যগুলো গুচ্ছগ্রাম ও লালমাটি দিয়ে নামিয়ে জাফলং জিরোপয়েন্ট হয়ে রাধানগরে নেওয়া হয়। সেখান থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সূত্রমতে, সংগ্রাম ক্যাম্পের পাশে পাবলিক টয়লেট ও ইবু মার্কেটের আশপাশের প্রায় ৫০টি গুদামে ২০ হাজার পিসেরও বেশি ভারতীয় কম্বল মজুদ রয়েছে। এছাড়া রাধানগর কাফাউড়া, ইসলামপুর ও আলমনগর বাজারের গুদামগুলোতে বিপুল পরিমাণ কসমেটিকস, জিরা ও ওষুধ মজুদ করে রাখা হয়েছে।


স্থানীয়দের দাবি, কসমেটিকস ও জিরার আড়ালে এই সিন্ডিকেট মরণঘাতী অস্ত্র পাচার করছে। সম্প্রতি র‍্যাব ও বিজিবি কর্তৃক উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের নেপথ্যেও মন্নান ও ডালিম জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। মন্নান ও ডালিম দুজনেই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা এবং পাচারকৃত অস্ত্রগুলো তারা নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে পাঠাচ্ছেন।


বল্লাঘাটের এক সময়ের সাধারণ দোকান কর্মচারী মন্নান সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আশীর্বাদে রাতারাতি গডফাদারে পরিণত হন। বর্তমানে তিনি জেলা ডিবি ও থানার ওসির ‘লাইনম্যান’ পরিচয় দিয়ে লাখ লাখ টাকা চাঁদা তুলছেন। প্রতিবাদ করলে নেমে আসে নির্যাতন। গত ২২ অক্টোবর পাথরটিলার ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন শুভকে পিটিয়ে ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা লুট করে নেয় মন্নান বাহিনী। কিন্তু খুটির জোর বেশি হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগী।


এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, “সীমান্তে চোরাচালান হয়। আমরা অভিযান চালাচ্ছি। পুলিশ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”


গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, “আমি নতুন এসেছি। মন্নান মেম্বার ও ডালিমের নাম আজ শুনলাম। তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”


সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাফলং সীমান্ত থেকে এই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটনে উচ্চ পর্যায়ের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের জোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

এই সম্পর্কিত আরো