জুলাই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকাকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আন্দোলনের অগ্রনায়ক সাদিক কায়েম। তুরস্কের গণমাধ্যম ইয়েনি সাফাকে একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ঢাকাকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে একযোগে বিক্ষোভের সিদ্ধান্তই আন্দোলনের গতি নির্ধারণ করে দিয়েছে।
ইয়েনি সাফাক সাদিক কায়েমের কাছে জানতে চায়, এই বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক কোনগুলো ছিল? কীভাবে চাপ মোকাবিলা করেছেন?
জবাবে তিনি আরও বলেন, ১৮ জুলাইয়ের পর দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারফিউ এবং একের পর এক হত্যার ঘটনায় ভয় ও হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে পুরো আন্দোলনের সমন্বয় দায়িত্ব এসে পড়ে আমার কাঁধে। আমি প্রতিদিনের কর্মসূচি, বিবৃতি ও নেতাদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করি।
‘নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও মাহফুজ আলম ওই সময়কার মূল কৌশলগত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এস এম ফারহাদ, মোহিউদ্দিন খান, মনজুরুল ইসলাম, সিবগাতুল্লাহ ও রিফাতসহ অনেকেই নিরন্তর কাজ করে যান মাঠে ও আড়ালে। ড. মির্জা গালিব ছিলেন পুরো বিপ্লব জুড়ে কৌশলগত নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ মেধাস্রোত।’
‘আন্তর্জাতিক যোগাযোগে জুলকারনাইন সায়ের (আল-জাজিরা), সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন এবং পিনাকি ভট্টাচার্য অনবদ্য ভূমিকা রাখেন। দেশীয় মিডিয়া স্তব্ধ থাকলেও তারা তথ্য পৌঁছে দেন প্রবাসী ও বৈদেশিক মহলে।’
‘বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সাংবাদিক, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (ডুজা) ও মোবাইল সাংবাদিকেরা মাটির কাছাকাছি থেকে রিপোর্ট করে তথ্যপ্রবাহ জাগিয়ে রাখেন।’
ড. মির্জা গালিব ছিলেন পুরো বিপ্লব জুড়ে কৌশলগত নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ মেধাস্রোত।
-সাদিক কায়েম
‘চরমতম পরীক্ষাটি ছিল মনোবল ধরে রাখা। প্রতিদিন শতাধিক শহীদ হচ্ছেন, বহু সমন্বয়ক গ্রেফতার ও নির্যাতিত হচ্ছেন। ২৮ জুলাই রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে কিছু নেতাকে দিয়ে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণাও করানো হয়। আমরা তৎক্ষণাৎ তা প্রত্যাখ্যান করি এবং বলি—শেখ হাসিনা অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।’
‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁক আসে ৪ আগস্ট, যখন ‘নতুন বাংলাদেশ’ নির্মাণের ৯ দফা দাবি ও অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা একত্রিত করে চূড়ান্ত দাবি নির্ধারিত হয়—শেখ হাসিনার পদত্যাগ। আমি বুঝতে পারি, ৫ আগস্ট শাহবাগে দুপুর ২টায় বিক্ষোভ ডাকলে আওয়ামী লীগ আগে জায়গাটি দখল নিতে পারে। তাই আমি সকাল ১০টায় শুরু করার প্রস্তাব দিই এবং শেষ পর্যন্ত সেটিই বাস্তবায়িত হয়।’
‘এ সময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আবদুল কাদের, হান্নান মাসুদ, মাহিন সরকার, রিফাত রাশিদ এগিয়ে আসেন।’
‘আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নেতৃত্বের কাঠামোকে সংহত ও নির্ভরযোগ্য রেখেছি—চিহ্নিত ছাত্রনেতাদের বাইরে রেখে অভ্যন্তরীণ কৌশলগত নেতৃত্ব গড়ে তুলেছি। তাতেই আমরা সংগঠনের ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছি। ক্যাম্পাসের স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্রদের আমরা সাহস জুগিয়েছি, কিন্তু কৌশলগতভাবে নির্দেশনা দিয়েছি পেছন থেকে।’
‘ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? তরুণদের উদ্দেশ্যে আপনার বার্তা কী?’, ইয়েনি সাফাকের এমন প্রশ্নের জবাবে সাদিক কায়েম বলেন, আমি এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে নাগরিকের মর্যাদা, অধিকার ও স্বপ্ন রক্ষিত হবে—জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, কিংবা মতাদর্শ নির্বিশেষে।
‘যেখানে সরকার হবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, থাকবে মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা, এবং আইনের শাসন—যেখানে আইন হবে সকলের জন্য সমান।’
‘আমরা চাই এমন অর্থনীতি, যেখানে ধনিক শ্রেণির একচেটিয়া ক্ষমতা নয়—গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, নারী ও যুবকের জন্য হবে স্বনির্ভরতা ও সম্ভাবনার পথ। আমরা চাই এমন শিক্ষা, যা কেবল পরীক্ষায় পাস করানো নয়—চিন্তা, মানবিকতা ও নৈতিকতাকে উৎসাহিত করবে।’
‘তরুণদের বলব—এই বিপ্লব প্রমাণ করেছে, তরুণরাই জাতির চালিকাশক্তি। তোমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, পোস্ট, প্রতিবাদ—সবই ইতিহাস গড়েছে। কখনও নিজের কণ্ঠকে তুচ্ছ ভেবো না।’
‘আমি নেতৃত্বকে দেখি দায়িত্ব হিসেবে, ক্ষমতা নয়। আমি এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর যে ভালোবাসা ও আস্থা পেয়েছি—তা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।’
‘তবে আমি রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখি না। আমি চাই নেতৃত্ব গড়ে উঠুক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক হয়ে—ব্যক্তিনির্ভর নয়।’
‘আমি নিজেকে দেখতে চাই এক সংগঠক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে—যিনি তরুণ নেতৃত্বের বিকাশে সহায়তা করবেন।’
‘নতুন বাংলাদেশ শুধু সম্ভাবনা নয়—এটি সময়ের দাবি। হয় আমরা এগিয়ে যাব, নয়তো আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যাব। কিন্তু আমি নিশ্চিত, এবার আমরা এগিয়ে যাব—কারণ তরুণরা জেগে উঠেছে, জনগণ আর পেছনে ফিরবে না।’