বঙ্গোপসাগরের তলদেশে গ্যাসের মজুদ বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি কাজে লাগাতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘বিরাট বঙ্গোপসাগর আমাদের। আপনারা শুনেছেন কোনোদিন, সমুদ্র থেকে গ্যাস পেয়েছি? কিন্তু আশপাশের দেশগুলো সমুদ্র থেকে গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছে, আমাদের গ্যাসও তারা নিয়ে যাচ্ছে। ওখানে কোনো সীমারেখা, কোনো বর্ডার আছে নাকি? পাইপ দিয়ে তারা নিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের আঙুল চুষছি বসে বসে।’
নিউইয়র্কে শনিবার ‘এনআরবি কানেক্ট ডে: এমপাওয়ারিং গ্লোবাল বাংলাদেশী’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রের নিচে গ্যাস আছে এটা নিশ্চিত, এটাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা যদি এগুলোও খেতে না পারি, এর থেকে দুঃখ করার মতো আর কী থাকতে পারে?’
সমুদ্রসহ দেশের মানচিত্র তুলে ধরার কথা বলে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের দেশের যে মানচিত্র, বাংলাদেশ বলতে আমরা ওটাই বুঝি। আমিই বার বার মনে করি, এটা তো ছোট বাংলাদেশ, আমাদের আসল বাংলাদেশ কোথায়, পুরো সীমারেখা কোথায়? বিরাট বঙ্গোপসাগর কিন্তু আমাদের। এটা কখনো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বোঝানো হয় না। মানচিত্রটা এঁকে বোঝানো হয় এটাই বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শেষ হয় না, বাংলাদেশের মাত্র অর্ধেক স্থল, আর বাকি অর্ধেক বিশাল সমুদ্র। আমি বলেছি এখন থেকে সমুদ্রসহ বিশাল বাংলাদেশ দেখাতে হবে।’
বাংলাদেশের অসীম সম্পদ রয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, ‘মাটির নিচে যেমন সম্পদ, পানির নিচে ও ওপরে সব সম্পদ। এটা আমরা কেন ছাড়ব? বিশাল সমুদ্র যে আমাদের সামনে রয়েছে সেটা আমাদের চিন্তার মধ্যে আসে না। আমি বার বার এটা চিন্তার মধ্যে ঢোকানোর চেষ্টা করছি যে পুরো অর্থনীতির আয়োজনটা সমুদ্রকে চিন্তা করে করতে হবে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলাপ করেছি সমুদ্রকে কাজে লাগানোর জন্য, যা যা দরকার সে বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সমুদ্রের উপরিভাগটা হলো চলাচলের রাস্তা। দুনিয়ার যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো স্থানে যাওয়া যায়। ওখানে রাস্তা বানাতে হয় না, শুধু জাহাজ লাগে, বন্দর লাগে। আমরা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বসে আছি, ওই একটাই। যদিও এটা সমুদ্রবন্দর নয়, এটা নদীর একটা অংশ। চট্টগ্রাম বন্দরের জাহাজ সমুদ্রে থামে না, কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে থামে। সমুদ্রবন্দর সমুদ্রের ওপর থাকবে। কক্সবাজার-মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য প্রস্তুত। একটা গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ প্রায় শেষ হয়ে আসছে।’
আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাত রাজ্য সমুদ্রবন্দরের অভাবে স্থলবেষ্টিত। যদি আমরা তাদের জন্য সমুদ্র উন্মুক্ত করি, সবাই উপকৃত হবে। সুযোগ নিশ্চিত হলে সবাই বাংলাদেশমুখী হবে।’
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রবাসী বাংলাদেশীদের এ ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি একেবারে নিচে নেমে গিয়েছিল। আপনাদের রেমিট্যান্সই তা বাঁচিয়েছে। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার পেছনে আপনাদের রেমিট্যান্সই মূল চালিকাশক্তি।’
প্রবাসীদের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, ‘আপনারা এখন বাংলাদেশের অংশ। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিনিয়োগ ও ধারণা নিয়ে আসুন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হবে।’
তরুণদের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশে পর্যাপ্ত তরুণ জনশক্তি রয়েছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে কারখানা স্থানান্তর করে এ মানবসম্পদ কাজে লাগাতে এবং বাংলাদেশকে উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান জানাই।’
অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনও বক্তব্য দেন।
আয়োজনের শুরুতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন। তিনি জানান, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গৃহীত পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। গত এক বছরে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) দ্বিগুণ হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে ‘হারনেসিং ডায়াসপোরা অ্যাজ আ ন্যাশনাল অ্যাসেট’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনার আয়োজন করা হয়। এটি পরিচালনা করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী। আলোচনায় অংশ নিয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশীরা দেশের সম্পদ এবং জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে তারা বড় ভূমিকা রেখেছেন।’
আরেকটি প্যানেল আলোচনা পরিচালনা করেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান। এতে বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির, জামায়াত নেতা মোহাম্মদ নকীবুর রহমান এবং এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ড. তাসনিম জারা বক্তব্য দেন।