সাদা পাথরে লুটের দায় তাকে না দিতে অনুরোধ জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পাথর কতটুকু তুলল, লুট হলো, নিয়ে গেল- এটা আমার মন্ত্রণালয়ের দেখার কথা না। কিন্তু যেহেতু আমি পরিবেশকর্মী এবং দায়িত্বে আছি তাই আমি বলব না যে এটা অন্য মন্ত্রণালয়; আমি দায়িত্ব নেব।
‘কিন্তু পাথর লুট হয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা আমাকে দিয়েন না। এখন দেখা যাচ্ছে যে, এটা নিয়ে মামলা হয়েছে। কিন্তু এখানে যারা প্রকৃত দোষী, তাদের নাম তালিকায় আছে কি না- সেটাও আমাদেরকে দেখতে হবে।’ -যোগ করেন তিনি।
বিদেশ সফর শেষে রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে সিলেটের সাদাপাথর লুটসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলছিলেন রিজওয়ানা।
পাথর লুট প্রশ্নে রাজনীতিকরা ঐক্য গড়লেও শেষমেশ জনতার শক্তির কাছে তাদের হারহেয়েছে জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “আজকে জনগণের শক্তি দেখা গেছে। লুটেরা চক্রের বিরুদ্ধে মানুষ দাঁড়িয়ে গেলে- তখন যতই রাজনৈতিক শক্তি ওটাকে সাপোর্ট করুক না কেন, মানুষের শক্তিই জয়ী হয়ে আসে।”
গত বছরের ৫ অগাস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকেই সিলেটের অন্যান্য পাথর কোয়ারির মত ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরেও শুরু হয় ব্যাপক লুটপাট। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এ লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় শোরগোল পড়লে দুদকসহ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “এখানে যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে, এর বিপরীতে প্রশাসনের হয় যোগসাজশ করেছে, নতুবা নীরব থেকেছে অথবা দুটোই ঘটেছে। এজন্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব এবং দ্রুতই নেব।”
গত ১৪ জুন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) পরিদর্শন শেষে ফিরছিলেন পরিবেশ পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। সেদিন শ্রমিকদের নিয়ে উপদেষ্টাদের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় রাজনীতিকরা; কোয়ারি খুলে দেওয়াই ছিল তাদের দাবি।
সেই প্রসঙ্গ টেনে রিজওয়ানা বলেন, “যখন আমরা দুই উপদেষ্টা সেখানে গেলাম এবং আক্রান্ত হলাম। তারপর তিনদিন ব্যাপী ব্যাপক অভিযান হলো। সব স্টোন ক্র্যাশার মেশিনে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো।
“কিন্তু তার ৪-৫ দিন পর সব রাজনৈতিক দল এক হয়ে রীতিমত প্রেসার ক্রিয়েট করলো। তারা ঘোষণা দিলেন যে, পাথর তুলতে দিতে হবে। পরিবহন মালিকেরা বললেন যে, তারা ধর্মঘট করবেন।”
সাদাপাথরের এক বছরের ব্যবধানে পাল্টে যাওয়ার দৃশ্যপট সামনে আসার পর সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা দেখা যায়। এরপরই সরকার উদ্যোগী হয়ে লুটের প্রায় ১২ হাজার টন পাথর উদ্ধার করে ওই পর্যটনকেন্দ্রে ফেলেছে।
জুনে আক্রান্ত হওয়ার প্রসঙ্গ ধরে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “সেই সময় প্রতিবাদটা জোরালো হলে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন হতো। যাই হোক- বেটার লেট দেন নেভার।
“আমি জনগণকে ধন্যবাদ জানাই। তারা লুটেরা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদটা করেছে, যার ফলে আজকের অবস্থাটা সৃষ্টি হয়েছে। ভবিষ্যতে পাথর লুটবার আগে দুইবার চিন্তা করবে।”
গত ১৪ জুন জাফলং থেকে ফেরার পথে দুই উপদেষ্টার গাড়ি বিক্ষোভের মুখে পড়ে।
গত ১৪ জুন জাফলং থেকে ফেরার পথে দুই উপদেষ্টার গাড়ি বিক্ষোভের মুখে পড়ে।
‘আমরা নীতি ঠিকই প্রণয়ন করেছিলাম’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আন্দোলন করে পাথর উত্তোলন বন্ধে সফল হলেও উপদেষ্টা হিসাবে পাথর উত্তোলন ঠেকাতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার কথা তুলে ধরেছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
“পাথর লুটপাট যেন বন্ধ হয়, সেজন্যই ফিল্ডে গিয়েছিলাম। যারা লুটপাট করে তাদেরকে একটা বার্তা দিতে গিয়েছিলাম। গত ২০ বছরে পাথর লুটের বিরুদ্ধে কোন মন্ত্রীকে ফিল্ডে যেতে, আক্রান্ত হতে দেখেছেন?”
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “পাথর ইজারা ও বালু ইজারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যখন আমরা পরিবেশ আন্দোলন করছিলাম, তখন ২০১১ সালে একটা রায় পাই। সেটা হচ্ছে- জাফলংয়ে ডাউকি ও পিয়াইন ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) ঘোষণা করা।
“সেই আদেশ ক্রমাগত চেষ্টা করে ২০১৬ সালে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত আনতে পারছিলাম। ২০১৯ সালে এটাকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছিল।”
রিজওয়ানা বলতে থাকেন, “তখন আমাদের মনে হয়েছে ওখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটন করলে সব শ্রমিক সেখানে পুনর্বাসিত হবে এবং পাথর কোয়ারিটাও রক্ষা পাবে। পিয়াইন ও ডাউকিতে ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাথর তোলা বন্ধ ছিল। এই মামলার বাদী এককভাবে আমিই ছিলাম।”
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তিন দিন বাদে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সেই সরকারে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন।
“নতুন সরকার দায়িত্বে আসার পর যুক্তি হাজির করা হলো যে- এগুলো থেকে পাথর তো চুরি হচ্ছেই। তাহলে আমরা লিজ দেই না কেন? আমরা পাল্টা যুক্তি দিলাম যে, পাথর যদি চুরি হয়- তাহলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তার মানে এই নয় যে আবার লিজ দেওয়া শুরু করব,” বলছিলেন রিজওয়ানা।
প্রতিবেশগত সংবেদনশীলতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিষয়টি তুলে ধরে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, “এগুলো দেখতে খুব সুন্দর। ভিয়েতনামে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে মানুষ আসে এই ধরনের নদী দেখতে। সবশেষ আমরা আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে মোট ১৭টি পাথর কোয়ারি ইজারা দেওয়া যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হলাম। সরকারি পর্যায়ে আমাদের কাজ হচ্ছে নীতি প্রণয়ন করা। আমরা নীতিটা ঠিকই প্রণয়ন করেছিলাম।
“এখন পাথর আদৌ উত্তলন হচ্ছে কি না, এটা দেখবে মাঠ প্রশাসন। আমরা কিন্তু বারবার প্রশাসনকে বলেছি, লিখেছি।”
নিজের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যখন দেখলাম যে প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না, বা নিচ্ছে না। তাদেরকে সাহস দেওয়ার জন্য আমি এবং ফাওজুল কবির ভাই (খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা) আমরা দুইজনই ফিল্ডে গেলাম।
“যখন আমরা ফেরত আসলাম, তখন আমাদের গাড়ি ধরে অশ্লীল বিক্ষোভ প্রদর্শন করলো। পরবর্তীতে সেই বিক্ষোভের জের ধরে একটা রাজনৈতিক দল তার নেতাকর্মীদেরকে বহিষ্কার করলো।”
দুই উপদেষ্টার গাড়ি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ খানকে বহিষ্কার করা হয়। আর সাদাপাথর নিয়ে শোরগোলের মধ্যে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে দলটি।
এর আগে উপদেষ্টাদের আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিনের মাথায় পাথর কোয়ারি ফের ইজারার মাধ্যমে খোলার দাবিতে সিলেটে নগরে মানববন্ধন করেছিল পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। আর তাতে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতারা।