সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
জাতীয়

তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট, বাস্তব পরিস্থিতি কী?

হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স সম্প্রতি বিশ্বের শক্তিশালী পাসপোর্টের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশ গত বছরের চেয়ে তিন ধাপ এগিয়ে ৯৪তম স্থানে উঠে এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ৯৭ তম স্থানে ছিল। 

শক্তিশালী পাসপোর্টের র্যাংকিং করা হয় মূলত বিশ্বের কতগুলো দেশে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায় তার উপর ভিত্তি করে। 

হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স-২০২৫ অনুযায়ী, বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীরা বিশ্বের ৩৯টি দেশে ভিসা ছাড়া ভ্রমণ করতে পারবেন।  এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক মনে হলেও বাস্তব পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। বিষয়টি বুঝার জন্য আমাদের সেই ৩৯টি দেশ একটু দেখে নেওয়া যাক—  মালদ্বীপ, নেপাল,  ভুটান, শ্রীলঙ্কা,  বাহামা দ্বীপপুঞ্জ, বার্বাডোজ, বলিভিয়া, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, কেপ ভার্দে দ্বীপপুঞ্জ, কমোরো দ্বীপপুঞ্জ, কুক দ্বীপপুঞ্জ, জিবুতি, ডোমিনিকা, ফিজি, গ্রেনাডা, গিনি-বিসাউ, হাইতি, জ্যামাইকা, কেনিয়া, কিরিবাতি, মাদাগাস্কার, মাইক্রোনেশিয়া, মন্টসেরাত, মোজাম্বিক, নিউয়ে, রুয়ান্ডা, সামোয়া, সেশেলস, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডাইনস, গাম্বিয়া, টিমর-লেস্টে, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, টুভালু এবং ভানুয়াতু। 

এই তালিকার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ- মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ছাড়া অন্য দেশেগুলোতে বাংলাদেশি পর্যটকরা তেমন একটা ভ্রমণ করেন না বললেই চলে।

বাস্তব পরিস্থিতি কী

বাংলাদেশিদের আগ্রহের গন্তব্য হলো মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো।  এসব দেশে বর্তমানে ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। 

মালয়েশিয়া গত জুলাই মাসেই ৩০০’র বেশি বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ বাংলাদেশিকেই দেশটির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এখন কথা হলো- বাংলাদেশ থেকে বিমানে উঠার সময় অবশ্যই তাদের মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট দেখেই অনুমতি দেওয়া হয়। তার মানে ভিসা থাকলেও দেশটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে।  দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিরাপত্তাজনিত সন্দেহে এবং কাগজপত্রে অসঙ্গতি থাকায় তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পাশাপাশি মালয়েশিয়ায় প্রতিনিয়ত বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশিদের আটক হওয়ার ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়।  এসব কারণে ভবিষ্যতে দেশটিতে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ভিসা পাওয়া আরও কঠিন হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। 

বাংলাদেশিদের অন্যতম শীর্ষ বিদেশ গন্তব্য ভারত। দেশটি গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর গুরুতর অসুস্থ রোগী ছাড়া অন্যদের ভিসার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তা এখনো বহাল আছে।

আরব আমিরাত বহুদিন বন্ধ রাখার পর গত ৮ মার্চ আবার বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া শুরু করে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে গত ১০ মে থেকে আবার ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে।

গত জুনে আমিরাত সরকারের একজন কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সুহাইল সায়িদ আল খালিল ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার দিকগুলো আবার তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকীর কাছে। লুৎফে সিদ্দিকী গত ১৭ জুন এক পোস্টে বলেন, আমিরাতে ভিসা ও অবস্থানের নিয়মকানুন ভাঙার ২৫ শতাংশের বেশি ঘটনা ঘটিয়ে থাকে বাংলাদেশিরা। অথচ সরকারি হিসাবে আমিরাতে কাজসহ বিভিন্ন কারণে থাকা বিদেশিদের মাত্র আট শতাংশ বাংলাদেশের নাগরিক।

যুক্তরাজ্য ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে বাংলাদেশিদের ৫৪.৯০ শতাংশ ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে, যেখানে বৈশ্বিক গড় প্রত্যাখ্যানের হার ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। এসময় বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ৩৮ হাজার ১৭৯ জন বিভিন্ন ক্যাটগরিতে ভিসা পাওয়ার জন্য দেশটিতে আবেদন করে। এর মধ্যে ২০ হাজার ৯৬২ জনেরই আবেদন নাকচ হয়।  শেঞ্জেন ভিসা অঞ্চলগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে।

পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামের পাশাপাশি অনেকে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশেও ঘুরে আসেন। তবে ভ্রমণে গিয়ে কেউ সেখানে থেকে যান, কেউ আবার অবৈধভাবে অন্য দেশে পাড়ি জমান। এসব কারণে বাংলাদেশি পর্যটকদের জন্য ভিসাপ্রাপ্তি কঠিন করে তুলেছে দেশগুলো। আগে যেখানে ই-ভিসা কিংবা অন-অ্যারাইভাল সুবিধায় সহজেই ভ্রমণ করা যেত, এখন সেখানে ভিসা পেতে সময় লাগছে এক থেকে দুই মাস। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাতও হচ্ছে।

থাইল্যান্ডে ভ্রমণের জন্য কমপক্ষে ৪৫ দিন আগে ভিসার আবেদন করতে হচ্ছে, যা সাধারণ পর্যটকদের জন্য বড় ভোগান্তি। থাইল্যান্ডের পাতায়া, ফুকেট কিংবা ব্যাংকক ছুটি কাটানোর জনপ্রিয় গন্তব্য হলেও এখন সেখানকার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যানের হার অনেক বেশি। আবার যারা ভিসা পাচ্ছেন তাদের সময় লাগছে দেড় থেকে দুই মাস। একই অবস্থা অন্যান্য দক্ষিণ পূর্ব এশীয় দেশগুলোতেও।

 

বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দেশের মিশনগুলো ভিসার আবেদন যাচাইয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি বাড়িয়েছে। সরকারি সফরের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি থাকলে আগে তুলনামূলকভাবে সহজে ভিসা পাওয়া যেত। এখন এমন চিঠি থাকার পরও সম্প্রতি উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তার ভিসার আবেদন নাকচ হয়েছে।

মার্কিন দূতাবাস সম্প্রতি একাধিক ফেসবুক পোস্টে বলেছে, প্রত্যেকের ভিসা আবেদন খুঁটিয়ে দেখা হয়। আবেদনকারীকে বিস্তৃত নিরাপত্তা যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও সন্ত্রাসবিরোধী ডেটাবেইসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার কাজ। আবেদনকারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কী ধরনের পোস্ট দেন তা-ও খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।

জার্মানি যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ভিসার সাক্ষাতকারের জন্য সময় পেতেই এখন দেড় থেকে দুই বছর লেগে যাচ্ছে।

এমন জটিলতার পেছনের কারণ হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশের হাজার হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট দেশে অবৈধভাবে থেকে যাওয়ার প্রবণতা সাধারণভাবে অন্যদের ভিসা পাওয়ার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া জাল কাগজপত্র জমা দেওয়া, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য না দেওয়া এবং মারাত্মক ভুল তথ্য দেওয়ার কারণে ভিসা আবেদন নাকচ হয়। এর বাইরে দূতাবাসে ভিসা কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্য জবাব দিতে না পারা, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ানো এবং ভিসার মেয়াদ শেষে ফিরে আসার নিশ্চয়তা না দিতে পারার কারণেও ভিসা আবেদন নাকচ হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নেতিবাচক এই দিকগুলো আগেও ছিল, তবে এখন অনেক বেড়ে গেছে।

ভিসার ক্ষেত্রে ব্যাপক কড়াকড়ির সুযোগ নিতে তৎপর রয়েছে দালালচক্র। এই চক্রের অনেকেই সহজে ভিসার মিথ্যা নিশ্চয়তা দিয়ে ফেসবুকসহ বিভিন্ন উপায়ে প্রচারণা চালায়। বহু ভিসাপ্রার্থী তাদের ফাঁদে পা দেন।

কী কী কারণে ভিসার আবেদন নাকচ হয়

ভিসাপ্রার্থীদের একটি বড় অংশ আবেদনের প্রক্রিয়া নিজে সম্পন্ন করেন না। অর্থের বিনিময়ে আবেদন করতে গিয়ে বিভিন্ন পেশাদার এজেন্টের সহায়তা নেন। অসাধু এজেন্টরা টাকা নিয়ে ভিসাপ্রার্থীদের জানিয়ে বা না জানিয়ে আবেদনপত্র নিজেদের ইচ্ছেমতো পূরণ করেন। নিজেরাই কাগজপত্র তৈরি করে দেন। দূতাবাসগুলো যাচাই করে অনেক আবেদনকারীর কাগজপত্র জাল ও তথ্যে ভুল দেখতে পায়।

ইংরেজি-প্রধান দেশে কাজ করতে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে, এমন অনেক ভিসাপ্রার্থী সাক্ষাৎকারে সাধারণ ইংরেজিতেও কথা বলতে পারেন না। এমনকি, কিছু আবেদনকারী দোভাষীর কাছে বাংলাতেও নিজের তথ্য জানাতে বা প্রশ্নের জবাব ঠিকমতো দিতে পারে না।

এই সম্পর্কিত আরো