ক্লাস শেষ। স্কুল ছুটি। শিশুরা ছুটে যাবে মায়ের কোলে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ আকাশ থেকে ধেয়ে আসে মৃত্যুদূত প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। গতকাল দুপুরে রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে আছড়ে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। ভবনের দোতলা বরাবর সরাসরি আঘাত হানে বিমানটি। তারপর ভবনটির ফটকে বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত ১৭১ জনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অধিকাংশই অগ্নিদগ্ধ। হতাহতের মধ্যে কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এই মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় সারাদেশের মানুষ স্তম্ভিত, শোকে মুহ্যমান, নির্বাক। চারদিকে বিষাদের কালো ছায়া। আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মাইলস্টোন কলেজের প্রভাষক রেজাউল ইসলাম জানিয়েছেন, তখন স্কুল ছুটির ঠিক আগ মুহূর্ত। হঠাৎ একটা প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান সরাসরি বিল্ডিংয়ে আঘাত করে। সেটা জুনিয়র সেকশনের বিল্ডিংয়ের ওপর পড়ে। এই ভবনে নার্সারি, ওয়ান, টু, থ্রি- এসব ক্লাস
চলে। বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর বিল্ডিংয়ের গেটে একেবারে গর্ত হয়ে আগুন ধরে যায়।
দুর্ঘটনার পর সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, দোতলা হায়দার আলী ভবনটি পশ্চিমমুখী। মাঝখানে প্রধান ফটক ও দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। বিমানটি সোজা ওই ফটকে আছড়ে পড়লে ভবনটি এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। বিকাল পর্যন্ত স্কুলের বাগান সংলগ্ন ভবনটির নিচতলায় দুর্ঘটনাকবলিত বিমান থেকে আগুনের ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ও সেনাসদস্যরা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিমানটির বিভিন্ন অংশ কেটে বের করছেন। আগুনে পোড়া কোমলমতি শিশুদের মরদেহ উদ্ধার করার এবং গুরুতর আহত হওয়ার পরের একাধিক ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান
নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলাস্থ বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় বৈমানিকসহ ২০ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়েছেন। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র?্যাব ও ফায়ার সার্ভিস অকুস্থলে উদ্ধার তৎপরতা চালায়। দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য বিমানবাহিনীর একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সিয়াম বলেন, ভবনের দুটি তলায় ১৬টি ক্লাসরুম আছে। আর ৪টি শিক্ষকদের রুম। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস ওই ভবনে হয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাসরুমের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়।
দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বিধ্বস্ত বিমানটির অংশবিশেষ দেখে বোঝা যায়, বিমানটি স্কুল ভবনের সামনে পড়ে ছিটকে ভবনের সিঁড়ির সামনে চলে যায়। আর এর দুটি পাখার আঘাতে ধ্বংস হয় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পূর্ণ দুটি ক্লাসরুম। দুটি কক্ষই পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা নাম প্রকাশ না করে বলেন, দুর্ঘটনার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি ছেলেকে নিয়ে হায়দার ভবনের গেট দিয়ে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে চলে আসেন। যখন প্রধান ফটকের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন, ঠিক সেই সময় বিমানটিকে আছড়ে পড়তে দেখেন। এরপরই শিশুদের আর্তচিৎকার শুনতে পান। তার ভাষ্য, অল্পের জন্য তার সন্তান রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু চোখের সামনেই অনেক শিশুকে পুড়ে মরতে দেখেছেন। এ কথা বলার পর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন ওই অভিভাবক।
বিকট শব্দে বিমানটি বিধস্ত হওয়ার পরপরই স্থানীয় দোকানদার শামীম ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এমন মৃত্যু কখনও দেখেননি। বাঁচার জন্য আর্তচিৎকার করছে শিশুরা। আগুনে কারও কারও শরীরের চামড়া গলে পড়ছে। একজন অভিভাবক পুড়ে যাওয়া শিশুসন্তানকে উদ্ধার করেন। তখন বাচ্চাটার শরীরের চামড়া খসে পড়ছিল। এই বিভীষিকা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন বলে তিনি জানান।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বিজয় আমাদের সময়কে জানান, দুপুর ১টার দিকে কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হন তিনি। কিছুক্ষণ পর ঘটনাস্থলে ছুটে যান। বিজয় বলেন, আমি ১২ জনের লাশ বের করেছি। সবাই পুড়ে অঙ্গার। এ দৃশ্য দেখার মতো না। নিহতদের বেশিরভাগই শিশু। তারা ক্লাস শেষে স্কুল থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ক্ষোভ প্রকাশ করে বিজয় বলেন, জনবহুল এলাকায় কেন বিমান প্রশিক্ষণ নেবে আর নিষ্পাপ শিক্ষার্থীদের প্রাণ দিতে হবে?
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২০ জন নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। আহত ১৭১ জনকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৭০ জন, সিএমএইচে ১৪ জন এবং উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ৬০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শনাক্ত করা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। শনাক্ত করতে না পারলে ডিএনএ টেস্ট করা হবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, দোতলা ভবনের প্রথম তলায় ছিল তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস। দ্বিতীয় তলায় ছিল দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস। তার সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপালের অফিস মিটিং রুম। ক্র্যাশ ল্যান্ডিং যখন হয়, তখন স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল এবং ওই সময় যে জায়গায় ক্র্যাশ ল্যান্ডিং হয়, সেখানে বাচ্চারা জড়ো হয়েছিল; তাদের সঙ্গে হয়তো কিছু অভিভাবকও ছিলেন।
ভবনের ফটক বন্ধ হওয়ায় আটকে পড়ে শিক্ষার্থীরা : প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে, ভবনটির প্রধান ফটকে সব সময় স্কুল স্টাফরা বসে থাকেন, সিঁড়ির নিচে স্টাফদের কক্ষ রয়েছে। বিমানটি ফটক ভেঙে কক্ষের ভেতরে ঢুকে যায়। আগুনের তীব্রতায় পুরো ভবন কালচে হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা বলেছে, বিমানটি ভবনের প্রধান ফটকের ভেতর ঢুকে যাওয়ায় ভেতরে থাকা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা আর বের হতে পারেনি। ভবনটির চারপাশে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো। তাই নিচে যারা ছিল, তারা আর বের হতে পারেনি।
হাসপাতালে আহাজারি : গতকাল দুপুর পার হতেই জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে। স্ট্রেচারে করে নামানো হয় দগ্ধ শিশু-কিশোরদের। অ্যাম্বুলেন্স থামলেই অভিভাবকরা সন্তানকে খুঁজে পাওয়ার আকুতি নিয়ে ছুটে যান। কেউ কেউ আশঙ্কাজনক অবস্থায় সন্তানকে দেখে জ্ঞান হারান। আবার নিজের সন্তানকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
চিকিৎসকরা জানান, পোড়া রোগীদের জন্য প্রচুর রক্তের দরকার হয়। পজিটিভ রক্ত পাওয়া গেলেও নেগেটিভ রক্তের ঘাটতি রয়েছে। নেগেটিভ রক্ত দেওয়ার জন্য তারা আহ্বান জানান। জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান জানিয়েছেন, বার্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় সবাই স্কুলের শিক্ষার্থী। তাদের সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, একের পর এক আহত ও নিহতদের স্কুল থেকে বের করা হচ্ছে। আর প্রিয় সন্তানকে খুঁজে পেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তাদের বাবা-মা। স্কুলের বাইরে দিয়াবাড়ী গোল চত্বরে হাজার হাজার উৎসুক জনতার ভিড়। তাদের সামলাতে কাজ করছিল সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও স্বেচ্ছাসেবীরা। প্রিয় সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে অনেককেই সেখানে গগনবিদারী আহাজারি করতে দেখা গেছে।
আজ রাষ্ট্রীয় শোক : আজ মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং বেসরকারি ভবন ও বিদেশে বাংলাদেশি মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা।