শেখ হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে ৩রা আগস্ট একদফার ঘোষণা হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে। দ্রোহ ও বিদ্রোহের প্রতীক সেই শহীদ বেদি থেকেই ঘোষণা আসছে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের। আজ বিকাল ৩টায় ভূতাপেক্ষ এ ঘোষণাপত্র ঘোষণা করবেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। যেখানে উপস্থিত থাকবেন ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পাওয়া প্রতিনিধিরাও। বিপ্লবের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ব্যাপক জনসমাগমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে অভ্যুত্থানের প্রায় চার মাস পর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রকে দুরভিসন্ধিমূলক বলে মনে করছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ছাত্র অধিকারসহ সমমনা অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন এ জনসমাগমে যোগ দেবে না বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরে সরাসরি কিছু না বললেও সংগঠনটির নেতাকর্মীরা সেখানে থাকবেন বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৫৮ সমন্বয়কের শপথের মধ্য দিয়ে এ ঘোষণাপত্রকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। রোববার ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানানো হয়।
বিপ্লবীদের এ ঘোষণাপত্র ৫ই আগস্টের হিসেবে বিবেচিত হবে। ভূতাপেক্ষ এ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিগত জনবিরোধী ব্যবস্থার বিলোপ ও আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাবে বলে মনে করেন অনেকে। তবে এই ঘোষণাপত্র নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই রাজনৈতিক অঙ্গণে। সাধারণ মানুষেরও আগ্রহ, কী থাকছে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণায়। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জানিয়েছেন, এ বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে। আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করা হবে দেশের রাজনীতিতে। কবর রচনা করা হবে মুজিববাদী ১৯৭২ সালের সংবিধানের। ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ঘোষণাপত্রে স্থান পেতে পারে ঔপনিবেশিক শাসনামল থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সংগ্রামী ইতিহাস। এ ছাড়াও ’৭২ এর মুজিববাদী সংবিধানের সমালোচনা থাকতে পারে ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রে। ছাত্র আন্দোলনের নেতারা মনে করেন, দেশের গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো এ সংবিধানের কারণে ধ্বংস হয়েছে। এ সংবিধানের দোহাই দিয়ে কেড়ে নেয়া হয়েছে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার। সমালোচনা থাকতে পারে ১/১১ এর ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া নিয়েও। শেখ হাসিনা ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কীভাবে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছেন তার উল্লেখও থাকতে পারে। যার মাধ্যমে দেশে গুম-খুনের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে মনে করেন বিপ্লবীরা। উল্লেখ থাকতে পারে রাষ্ট্রীয় মদদে পিলখানা, শাপলা চত্বরসহ বিভিন্ন হত্যাযজ্ঞের। ঘোষণাপত্রে উল্লেখ থাকতে পারে ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণে কীভাবে দেশে গুম খুনের রাজনীতি কায়েম করেছে হাসিনা সরকার। এ ছাড়াও কীভাবে বিগত শেখ হাসিনা সরকার সংখ্যালঘু টার্মকার্ড ব্যবহার করে এ দেশে বিভাজন তৈরিতে কাজ করেছে। ন্যায্য দাবিতে রাজপথে নেমে আসা শ্রমিক হত্যার কথাও স্থান পেতে পারে। এ ছাড়াও ঘোষণাপত্রে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ফ্যাসিজম কীভাবে কাজ করেছে তার উল্লেখ থাকতে পারে। এ ব্যবস্থার কারণে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করেছে বলে মনে করেন বিপ্লবীরা। সমালোচনা থাকতে পারে বিগত তিনটি অবৈধ নির্বাচনের বিষয়েও। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন, নাগরিক বৈষম্যের কথা স্থান পেতে পারে। বিশেষ করে জুলাই আগস্টের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানে ছাত্রদের আন্দোলনে এ দেশের আপামর জনসাধারণের সম্পৃক্ততার কথা বীরত্বের সঙ্গে উল্লেখ থাকতে পারে। একইসঙ্গে সেই আন্দোলনে হাসিনার দমন-পীড়ন ও হত্যাযজ্ঞের কথা গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ থাকবে। বিপ্লবীরা মনে করেন, এ আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশ্রুত পুনরুদ্ধার করা গেছে। ঘোষণাপত্রে গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ থাকতে পারে হাসিনার পতনের পর বঙ্গভবনের বৈঠকে প্রেসিডেন্টের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবির বিষয়টিও। বাতিল চাওয়া হতে পারে ১৯৭২ সালের সংবিধানের। একইসঙ্গে ঘোষণাপত্রে গুম, খুনসহ মানবতাবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের বিচার চাওয়া হতে পারে। ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে মূলত শিক্ষার্থীরা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি করবেন। একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকা সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার আহ্বান জানানো হবে।
এদিকে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির মানবজমিনকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রেখে জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের পাঁচ মাসের মাথায় এসে হঠাৎ করে কথিত ‘বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণা করা দুরভিসন্ধিমূলক। একটি বিশেষ গোষ্ঠী ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মালিকানা ছিনতাই করার লক্ষ্যে এক ধরনের হঠকারী পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিজেদের রাজনৈতিক উচ্চাবিলাষ থেকে এখন আবার নতুন করে বিপ্লবের ইশতেহার সামনে আনতে যাচ্ছে। তারাই এখন ক্ষমতায়, ক্ষমতায় থেকে কার বিরুদ্ধে বিপ্লব করবে? আমরা মনে করি, এমন পদক্ষেপ ডক্টর ইউনূসের সরকারের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী পদক্ষেপ। অহেতুক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। এই ঘোষণাপত্র পাঠের পেছনে একাত্তরের পরাজিত শক্তির ইন্ধন রয়েছে। তারা একাত্তরের ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে রাজনীতি করতে চায়।