ছয় মাস আগে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নতুনভাবে দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে বাংলাদেশের দায়িত্ব তুলে দেন ছাত্র-জনতা। কিন্তু শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিজমের অবসান হলেও নতুন নেতৃত্বে বাংলাদেশ খুব ভালো নেই। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দেশজুড়ে অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকটসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
সর্বশেষ, গত বুধবার রাত থেকে শেখ হাসিনার সমর্থকদের লক্ষ্য করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সাবেক সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর এবং অনেক প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে।
এসব ঘটনার পর আজ শুক্রবার সকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস উইং একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে জানায়, এই ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে, কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করছে। সরকার এই ধরনের কাজ কঠোরভাবে দমন করবে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, সরকার জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তুত।
শুক্রবার বিকেলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে আরেকটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে তিনি দেশের সকল নাগরিককে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করতে এবং শেখ হাসিনা ও তাঁর সমর্থকদের বাড়িঘর ও স্থাপনায় হামলা না করার আহ্বান জানান।
তবে এই বিবৃতিগুলো আসে ৩২ নম্বরসহ বিভিন্ন স্থানে হামলার ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় পরে। হামলার আগে সারা দিন শেখ হাসিনার সমালোচক ও ছাত্র আন্দোলনের নেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালান। তাঁরা শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনের দিকে ‘বুলডোজার মিছিল’ করার ঘোষণা দেন। হামলাকারীরা বাসভবনে ঢুকে হামলা চালালেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় থাকে। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল তাদের থামানোর চেষ্টা করে, কিন্তু পরে সেখান থেকে সরে যায়।
ঢাকার একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে জানান, গত বুধবার থেকে দেশজুড়ে প্রায় ৭০টি হামলার খবর পাওয়া গেছে। আজ শুক্রবার দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সারা দেশে শেখ হাসিনার সমর্থকদের লক্ষ্য করে কমপক্ষে ২০টি জেলায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। চ্যানেল ২৪-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৩৫টি জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
গণ-অভ্যুত্থান
গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের দায়িত্ব দেন ছাত্র-জনতা। বর্তমানে ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। সামরিক বাহিনী সরকারকে সহায়তা করছে।
এদিকে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। এর জেরেই ক্ষুব্ধ জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকারীরা গত বুধবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ভাঙচুর করেছে বলে জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘ভারত থেকে পলাতক শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।’
অন্যদিকে শেখ হাসিনা ভারতে বসে ড. ইউনূসকে দায়ী করে বলেছেন, তাঁর সরকার হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিককে তলব করে এবং শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যকে ‘মিথ্যা ও উসকানিমূলক’ বলে অভিহিত করে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক বক্তব্যের প্রতিবাদে ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনারের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ভারতকে অনুরোধ করা হয়েছে, তারা যেন শেখ হাসিনার এমন বক্তব্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকে।
শেখ হাসিনা কি ফিরে আসতে পারেন
১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, দমন-পীড়ন, গুম, খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে এবং তিনি বিচারের মুখোমুখি হবেন। কিন্তু তিনি কি দেশে ফিরতে পারবেন?
ভারত থেকে দেওয়া বক্তৃতা এবং ফাঁস হওয়া একাধিক ফোনালাপে দেশে ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার ভারত থেকে তাঁকে ফেরানোর অনুরোধ জানালেও এ বিষয়ে এখনো কোনো জবাব দেয়নি দিল্লি। বাংলাদেশ ইন্টারপোলকেও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে অনুরোধ করেছে।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বেশির ভাগ দেশ ছেড়েছেন। কেউ কেউ কারাগারে আছেন, বাকিরা আত্মগোপনে। দলটির দাবি, শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে সারা দেশে শতাধিক কর্মী ও সমর্থক নিহত হয়েছেন। তবে এ দাবির সত্যতা যাচাই করেনি এপি।
এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়টি খুবই কঠিন এবং অসম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে।
সংস্কার নিয়ে অনিশ্চয়তা
অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনব্যবস্থা, আইনের শাসন, প্রশাসনিক কাঠামোসহ ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।
সরকার বলছে, সংস্কারের বিষয়ে এসব কমিশনের সুপারিশ শিগগির প্রকাশ করা হবে। তবে বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তাদের দাবি, দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের অধীনে হওয়া উচিত।
মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সরকারকে বিচারবহির্ভূত আটক ও সমালোচকদের দমনমূলক আইনের হাত থেকে রক্ষা করতে বলেছে। এ ছাড়া সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলেও নতুন অধ্যাদেশে একই ধরনের বিতর্কিত ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যম দমনের অভিযোগ এনেছে সম্পাদকদের সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) ও রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সাংবাদিকদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সরকার বলছে, দেশে কোনো গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়নি।
এদিকে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ অভিযোগ করেছে, সম্প্রতি দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন বেড়েছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, এসব সহিংসতা রাজনৈতিক কারণে হয়েছে, ধর্মীয় কারণে নয়।
ইসলামপন্থীদের উত্থান
শেখ হাসিনার পতনের পর সবচেয়ে চিন্তার যে বিষয়, সেটি হলো বাংলাদেশে আবারও ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী একটি সংস্থার প্রধান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘এই ধরনের সহিংসতা নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা হুমকির মুখে ফেলতে পারে। চরমপন্থী দল ও ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলো মূলত বর্তমান রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছে।’
এ ছাড়া অভ্যুত্থানের সময় জেল থেকে পলাতক প্রায় ৭০০ বন্দীর মধ্যে অন্তত ৭০ জন চরমপন্থী ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বলে জানা গেছে। এটিও বড় আশঙ্কার বিষয়।
পরবর্তী নির্বাচন কবে
চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। অন্যথায় তারা আন্দোলনে যাবে বলে জানিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, তারা নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য বর্তমান সরকারকে সময় দেবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাপানি সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে।