বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন বেড়েই চলেছে। গতকাল মঙ্গলবার দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং কলকাতা ও মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। তবে মিশনগুলোতে হামলা বা কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। যদিও নিরাপত্তাজনিত কারণে দিল্লি ও শিলিগুড়ির পর আগরতলা, গুয়াহাটিস্থ বাংলাদেশ মিশনে ভিসা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এদিকে ১০ দিনের মাথায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে গতকাল আবারও তলব করে নয়াদিল্লি ও শিলিগুড়িতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলা এবং ভাঙচুরের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ঢাকা। ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে।a
সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে টানাপড়েন আছে। তিনি বলেছিলেন, বাস্তবতাকে মেনে নেওয়াই ভালো যে, আসলে এই সরকারের শুরু থেকে সম্পর্কে টানাপড়েন আছে ভারতের সঙ্গে। সম্পর্কের এই টানাপড়েন মেনে নিয়েই বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে। দুই পক্ষ থেকেই সম্পর্ককে এগোনোর চেষ্টা করতে হবে।
তবে সম্প্রতি ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি ও ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ড এবং উভয় পক্ষের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন বিরূপ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন আরও বেড়েছে। গত ১৪ ডিসেম্বর প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ওসমান হাদির ওপর হামলাকারীদের ভারতে পালিয়ে যাওয়া প্রতিরোধে ভারতের সহযোগিতা কামনা করে ঢাকা। এছাড়া ভারতে আশ্রয় নেওয়া ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত উসকানিমূলক বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্বেগের বিষয়টিও প্রণয় ভার্মাকে জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর গত ১৭ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পালটা তলব করে বাংলাদেশে ক্রমশ অবনতির দিকে যাওয়া নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের গভীর উদ্বেগের কথা জানায়। চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা সেন্টার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
গত বৃহস্পতিবার ওসমান হাদির মৃত্যুর খবরের পর বাংলাদেশে কয়েকটি ভারতীয় মিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। এরপর গত শনিবার রাত থেকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন, কলকাতায় উপ-হাইকমিশনসহ ভারতে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল আবারও তলব করা হয় ভারতের হাইকমিশনারকে।
দিল্লিতে হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ
ময়মনসিংহে পোশাকশ্রমিক দীপু চন্দ্র দাস হত্যার প্রতিবাদে গতকাল নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বাজরং দলসহ বেশ কয়েকটি হিন্দু সংগঠন। তবে হাইকমিশন ভবন থেকে ৫০০ মিটার দূরে আটকে দেওয়া হয় বিক্ষোভকারীদের। এ সময় তাদের কয়েক জন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে সংঘর্ষে জড়ায়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে, কয়েক শ বিক্ষোভকারীকে বাধা দিতে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশ। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে। পরে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকাল ভিএইচপি এই কর্মসূচির ডাক দিলে হাইকমিশনের সামনে নিরাপত্তা জোরদার করে দিল্লি পুলিশ। আর দ্য হিন্দু জানিয়েছে, এলাকাটিতে তিন স্তরের ব্যারিকেড বসিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
ভারতের আরেক গণমাধ্যম এনডিটিভির খবরে বলা হয়েছে, কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও একাধিক বিক্ষোভকারীকে ব্যারিকেড ভেঙে কূটনৈতিক স্থাপনার দিকে এগোতে দেখা যায়। তারা অন্তত দুই স্তরের ব্যারিকেড ভাঙে। এ সময় অনেককে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে দেখা যায়। তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে বিচার দাবি করতে থাকে। এক পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দ্য হিন্দু বলেছে, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের নিরাপত্তায় ১৫ হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
এর আগে গত শনিবার নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে একটি হিন্দু চরমপন্থি সংগঠনের সদস্যরা।
কলকাতা, মুম্বাই উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ
ময়মনসিংহে দীপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল কলকাতায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে গতকাল বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণের মিছিলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে ডেপুটি হাইকমিশনের কাছে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কলকাতা পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকাল ১১টায় কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন থেকে বেকবাগানে অবস্থিত বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশন ঘেরাও অভিযান শুরু করে বঙ্গীয় হিন্দু জাগরণ। দুপুর ২টা নাগাদ বিক্ষোভ মিছিল বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের কাছে পৌঁছতেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উত্তেজিত জনতার সঙ্গে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ব্যারিকেড ভেঙে ডেপুটি হাইকমিশনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। এরপর পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করতেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যান বিক্ষোভকারীরা। ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয় র্যাফ। অভিযোগ, পুলিশের লাঠির আঘাতে কয়েক জনের মাথা ফেটে যায়। কয়েক জনকে আটক করে পুলিশ। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই হিন্দু জাগরণের এই জমায়েতকে বেআইনি ঘোষণা করে পুলিশ। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। জানা গেছে, বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করেছে কলকাতা পুলিশ। পরে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নাগরিক মঞ্চ বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে মিছিল, মানববন্ধন করে। এদিকে মুম্বাইয়ে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের সামনেও বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। পিটিআইর খবর অনুযায়ী, ভিএইচপি, বজরং দলের কর্মীরা এই বিক্ষোভ করে। তবে সেখানে সংঘর্ষের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে উদ্বেগ ঢাকার
ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে দিল্লিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও কনস্যুলার এলাকাকে লক্ষ্য করে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ঢাকা। গতকাল মন্ত্রণালয়ের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, গত শনিবার নয়াদিল্লিতে কূটনৈতিক এলাকায় বাংলাদেশ হাইকমিশন ও হাইকমিশনারের বাসভবনের বাইরে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, সোমবার শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ ভিসা কেন্দ্রে বিভিন্ন উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর ভাঙচুরের ঘটনায় ভারত সরকারের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, কূটনৈতিক স্থাপনায় এরকম পরিকল্পিত সহিংসতা এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের মতো কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ ধরনের ঘটনা কেবল কূটনৈতিক মিশনের কর্মীদের নিরাপত্তাকেই হুমকির মুখে ফেলে দেয় না, বরং পারস্পরিক সম্মান, শান্তি ও সহনশীলতার যে নীতি রয়েছে তাকেও ক্ষুণ্ন করে। এসব ঘটনার বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে ভারত সরকারের প্রতি বাংলাদেশ আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, কূটনৈতিক কর্মী ও স্থাপনার মর্যাদা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারত সরকার তার আন্তর্জাতিক-কূটনৈতিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ।
আগরতলা, গুয়াহাটি মিশনেও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ
ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনের ভিসা ও কনস্যুলার বিভাগ অনির্দিষ্টকালের জন্য মঙ্গলবার থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির সহযোগী রাজনৈতিক দল তিপ্রমথার যুব সংগঠন ইউথ তিপ্রা ফেডারেশনের ভারত ঘেরাও কর্মসূচির পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তাজনিত কারণে গুয়াহাটিতে অবস্থিত বাংলাদেশ অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশন থেকেও ভিসা কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের কনস্যুলার সেবা ও ভিসা প্রদান সোমবার থেকে সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন। গত শনিবার রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে চরমপন্থি সংগঠন ‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনা’র বিক্ষোভ ও হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এ পদক্ষেপ এসেছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে যে বাংলাদেশ ভিসা আবেদন কেন্দ্র আছে, সেটির কাজকর্মও সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে। শিলিগুড়িতে বেসরকারি একটি সংস্থা বাংলাদেশ উপহাইকমিশনের হয়ে ভিসার আবেদন গ্রহণ করত। সোমবার কিছু বিক্ষোভকারী ঐ বেসরকারি সংস্থার এক নারী কর্মীকে হুমকি দেওয়ার পরে ঐ সংস্থাটি সাময়িকভাবে তাদের কাজকর্ম বন্ধ রেখেছে।