শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
শুক্রবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
জাতীয়

বিশ্বশান্তির ৬ সারথীর মরদেহ আসছে শনিবার

সুদানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সন্ত্রাসী ড্রোন হামলায় নিহত ৬ বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর মরদেহ শনিবার (২০ ডিসেম্বর) আনা হচ্ছে স্বদেশে। দেশে ফেরার পর যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও আনুষ্ঠানিকতায় সম্পন্ন হবে বিশ্বশান্তিতে জীবন দেয়া এ বীরদের জানাযা ও দাফন।

গত ১৩ ডিসেম্বর সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের একটি ঘাঁটিতে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী ড্রোন হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৬ জনের মৃত্যু ৯ জন আহত হন। আহত সকলের চিকিৎসা চলছে কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির আগা খান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে। তাদের কয়েকজন এরইমধ্যে চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছেন। বাকিরা সবাই শঙ্কামুক্ত। বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ড্রোন হামলাটি চালিয়েছিল ১৩ ডিসেম্বর সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিকস বেইসে।

ঘটনায় নিহত ৬ শান্তিরক্ষী হলেন- নাটোরের করপোরাল মো. মাসুদ রানা, কুড়িগ্রামের সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম ও সৈনিক শান্ত মন্ডল, রাজবাড়ীর সৈনিক শামীম রেজা, কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং গাইবান্ধার বাসিন্দা লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া। আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন- কুষ্টিয়ার বাসিন্দা লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, দিনাজপুরের সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন, ঢাকার করপোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, বরগুনার ল্যান্স করপোরাল মহিবুল ইসলাম, কুড়িগ্রামের সৈনিক মো. মেজবাউল কবির, রংপুরের সৈনিক মোসা. উম্মে হানি আক্তার, মানিকগঞ্জের সৈনিক চুমকি আক্তার এবং নোয়াখালীর সৈনিক মো. মানাজির আহসান।

শহীদ শান্তিরক্ষীদের আত্মত্যাগ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অঙ্গীকারের এক উজ্জ্বল ও গৌরবময় নিদর্শন হয়ে থাকবে। জীবন হাতে নিয়ে কেবল দেশে নয়, সমরে-শান্তিতে বিশ্বের তরেও তারা। যার সবশেষ উদাহরণ সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মহান দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ছয়জন বীর শান্তিরক্ষী শাহাদতবরণ। জাতিসংঘের পতাকা তলে বিশ্বশান্তি রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গের শপথ করেই তাদের সেখানে যাওয়া।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বিপুল অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সুদানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অসাধারণ পেশাদারিত্ব, সাহস আর আত্মত্যাগ দেখল বিশ্ববাসী। আহত আট জনের মধ্যে তিন জন নারী সৈন্য। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে সর্বোচ্চসংখ্যক শান্তিরক্ষী পাঠানো ১১৯টি দেশের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশ।

বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের যাত্রা শুরু হয়। 'নীল হেলমেট' পরে বিশ্বশান্তিরসারথী  হয়ে বাংলাদেশের অভিষেক ১৯৮৮ সালে ইরাক-ইরানে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে। তখন জাতিসংঘের ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক মিশনে ১৫ জন সদস্য পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ১০টি দেশে শান্তির পতাকা হাতে নিয়োজিত তারা।

এরই মধ্যে প্রথম বারের মতো ডিআর কঙ্গোতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তিনটি হেলিকপটার মোতায়েন করা হয়েছে। শুরু থেকে সুদানে সর্বশেষ ছয় জন নিহত হওয়া ছাড়াও এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ১৬৮ জন শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন সেনাবাহিনীর ১৩১ জন, নৌবাহিনীর চার জন, বিমানবাহিনীর ছয় জন এবং পুলিশের ২৪ জন। আহত হয়েছেন ২৭২ জন। শুরু থেকেই বিভিন্ন বৈশ্বিক মিশনে বাংলাদেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলীরাও অংশ নিয়েছেন, যা বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের অবদানের একটি দুর্দান্ত স্বীকৃতি। বৈশ্বিক ফোরামে নেতৃত্বের স্মারক। আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত। মিশনগুলো অনেক চ্যালেঞ্জে ভরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনুকূল নয় এমন জলবায়ু, সম্পদের অভাব-সব মিলিয়ে মিশন বাস্তবায়ন।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর অবদানের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রশংসায় 'শান্তির কূটনীতির মোরসাল' হিসেবে অভিহিত করেছে। শুধু যুদ্ধবিগ্রহের স্থগিতাদেশ রক্ষা বা সংঘাত প্রতিরোধ নয়, স্থানীয় জনগণের কল্যাণ, পুনর্গঠন এবং পুনর্বাসনে এমন ভূমিকা অন্য অনেক দেশের কোনো বাহিনীই দেখাতে পারেনি। তাদের শিক্ষা, স্কুল নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, শিশুদের শিক্ষা প্রসার ও নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের নমুনা শেখার মতো। তাই শিখছে, অভিজ্ঞতা নিচ্ছে। উপলব্ধি করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তি সদস্যরা কেবল অস্ত্রধারী সৈন্য নয়, মানবতার সৈনিকও। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সময়ের পরিক্রমায় শান্তি রক্ষার ইতিহাসে জাতিসংঘের অন্যতম নির্ভরযোগ্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে দেশের সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও বেসামরিক সদস্যরা। কেবল শান্তি প্রতিষ্ঠা পর্যই তাদের কাজ শেষ নয়।

মিশনগুলোতে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করা, নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের সহায়তায় কাজ করে। যুদ্ধপরবর্তী পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশ বা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি বা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজন, মানবিক সংকট মোকাবিলাসহ বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে। সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী সীমান্ত অঞ্চল আবেই, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র (সিএআর), সাইপ্রাস, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো), লেবানন, দক্ষিণ সুদান, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার বিরোধপূর্ণ অঞ্চল পশ্চিম সাহারা, ইয়েমেন, লিবিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে দায়িত্ব পালন নানা মাত্রায় কঠিন কাজ। সেই কঠিনেরে সঙ্গী করে জীবন বিলিয়ে দেয়া শান্তির সারথীদের মরদেহ শনিবার স্পর্শ করবে তাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে।

এই সম্পর্কিত আরো