দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে তুলতে সংস্কার কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের কার্যক্রম, আসন্ন ফেব্রুয়ারির ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে বাংলাদেশের ওপর সার্বিকভাবে নজর রাখছে বৈশ্বিক সম্প্রদায়।
বিশেষ করে আসন্ন ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেশি আগ্রহী। বিদেশিরা মনে করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে দেশে টেকসই স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করবে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক যাত্রা পুনরায় শুরু করতে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন দেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরা।
শুধু তাই নয় ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের একাধিক দেশের সরকার আনুষ্ঠানিক বিবৃতির মাধ্যমে এই সহযোগিতা বা সমর্থনের বার্তা প্রকাশ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা নিশ্চিত রাখতে যে সকল সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন সে সকল সংস্কার কাজে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা বা সমর্থনের কথাও কূটনীতিকরা প্রকাশে বলেছেন।
এক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি দেশের পক্ষে ব্যাপক কাজে লেগেছে। সর্বশেষ গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ সই অনুষ্ঠানকে নিয়েও বিদেশি কূটনীতিকরা ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
আন্তর্জাতিক বিশ্বের সকলেই সামনের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। বিদেশি কূটনীতিকদের মতে, ‘যত দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে যতই মঙ্গল। কেননা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।
শুধু তাই নয় দেশে স্থিতিশীলতা বিরাজের পূর্বশর্ত হচ্ছে সঠিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করা। এছাড়া নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেই বিদেশিরা বিনিয়োগে আগ্রহ পায়। তাই সামনের ভোট অনুষ্ঠান অনেক গুরুত্বপূর্ণ।’ বিদেশি কূটনীতিকরা চায় যে সামনের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং অবাধ হবে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে একাধিক বিদেশি কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে যে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারবে। ভোট অনুষ্ঠান স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও জবাবদিহিতামূলক হবে। মূল কথা সহিংসতা নয় উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোট অনুষ্ঠান হবে।’
ভোট অনুষ্ঠান কোন কোন রাজনৈতিক দল অংশ নিবে বা বাদ যাবে, এমন ধরনের প্রশ্নে তাদের জবাব হচ্ছে, ‘কোন কোন রাজনৈতিক দল ভোট অনুষ্ঠানে অংশ নিবে তা ঠিক করবে বাংলাদেশের জনগণ। যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে যে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ইস্যুতে তারা দ্রুতই একটি অন্তর্বর্তী দল পাঠাবে।
নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ একাধিক দেশের রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করে সামনের ভোটের পরিবেশ কেমন হতে পারে তা বোঝার চেষ্টা করছেন। শান্তিপূর্ণ ভোট অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করার কথাও জানিয়েছেন বিদেশিরা।
শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরা। তারা রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করে ভোট সংক্রান্ত পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করছেন।
অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র চীন আবার এদিক দিয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছে। ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের একাধিক কূটনীতিক জানায় যে সামনের ফেব্রুয়ারিতে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন তাই এই মুহূর্তে তাদের রুটিন কাজের বাইরে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকাণ্ড নাই। কেননা সামনের ভোট শেষে নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব।
এই মুহূর্তে কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ধরনের অংশীদারত্বমূলক কাজ শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেটা পছন্দ নাও হতে পারে। তাই নির্বাচিত সরকারের আগে বিদেশিদের সঙ্গে উন্নয়ন অংশীদারত্বে এই সময়ে বড় আকারের কর্মকাণ্ড যোগ হওয়ার সম্ভাবনা কম।
যেমন : তিস্তা ইস্যু। এই মুহূর্তে এশিয়ার অংশীদারত্বদের সঙ্গে এই ইস্যুতে বাংলাদেশের বড় আকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য উভয়পক্ষের আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে তা নাও টিকতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ড এগিয়ে রাখা হচ্ছে, যাতে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত একাধিকবার বলেছে যে তারা সামনের নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরো বলছে, ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন জটিল পজিশনে অবস্থান করছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে নতুন বৈচিত্র্য দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থান করায় এবং বঙ্গোপসাগরের তীরে থাকায় বিশ্বে ঢাকার তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের পানির তাপমাত্রা বিশ্বের অন্যান্য সাগরের চেয়ে ভিন্ন।
এজন্য বঙ্গোপসাগরের পানিতে সহজেই যুদ্ধ জাহাজ নোঙর করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়েও এই কারণে এখানে একাধিক যুদ্ধ জাহাজ নোঙর করেছিল। এই সময়ের বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ভূ-রাজনীতিতে চীন ও মিয়ানমারে ইস্যুতে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের ওপর শক্তিধর একাধিক রাষ্ট্রের নজর আছে।
শক্তিধর একাধিক দেশ বঙ্গোপসাগরে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যে বিষয়টি ‘যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়’ এমন ভুলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আবার প্রতিবেশী একটি দেশ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে ‘যুক্তরাষ্ট্র সেন্টমার্টিন চায়’ এমন ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে!
অতি সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, জুলাই সনদ ২০২৬ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। এই দলিল মৌলিক সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গড়ে ওঠা ব্যাপক ঐকমত্যের প্রতিফলন। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ২০২৬ সালের নির্বাচনের পথে দেশটি ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এটি তারই প্রমাণ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, বিদেশিরা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন অনুষ্ঠান এগুলো নিয়ে কথা বলার কারণ হচ্ছে এ দেশে তাদের বিনিয়োগ আছে। তারা চায় না যে তাদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হোক। বিদেশিরা এজন্য স্থিতিশীলতা চায়। স্থিতিশীলতা বজায় থাকলে তাদের বিনিয়োগ ঝুঁকিমুক্ত থাকে। এজন্য তারা গণতান্ত্রিক বা নির্বাচিত সরকারকে পছন্দ করে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ এখন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো সংস্কার কাজ চলছে। সামনে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে, যা প্রধান উপদেষ্টা একাধিকবার নিশ্চিত করেছেন। বিদেশিরা এসব বিষয় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ বাংলাদেশ ছোট দেশ হলেও এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে অনেক গুরুত্ব আছে।