ফ্ল্যাটকাণ্ডে বিতর্ক ওঠার পর থেকে বৃটেনের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির এমপি এবং বাংলাদেশের পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগের বিষয়টি তরান্বিত হচ্ছে। যদি টিউলিপ পদত্যাগে বাধ্য হন তাহলে তার জায়গায় নতুন কাউকে দেয়ার চিন্তা করছে তার দল। এ খবর দিয়েছে দ্য টাইমস।
এতে বলা হয়, গণমাধ্যমটিকে জানানো হয়েছে যে-টিউলিপের বিকল্প বিবেচনা করছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমারের জ্যেষ্ঠ মিত্ররা। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুর্নীতির সম্পৃক্ততা থাকার কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে টিউলিপের স্থলাভিষিক্ত প্রার্থী হিসেবে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়ার কথা ভাবছেন তারা।
গত সোমবার বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীর নীতিশাস্ত্র পর্যবেক্ষণকারী সংস্থার কাছে নিজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তদন্তের দাবি জানানোর আগেই টিউলিপের বিকল্প প্রার্থীদের চিহ্নিত করেন কর্মকর্তারা। অবশ্য স্টারমার বলছেন, টিউলিপের ওপর তার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এছাড়া ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র টিউলিপকে তার পদ থেকে সরিয়ে ওই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য সম্ভাব্য ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরির বিষয়টিকে ‘সম্পূর্ণ অসত্য’ বলে দাবি করেছেন।
তবে টাইমস এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, স্টারমারের বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে টিউলিপের বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমটি বলছে, গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির তদন্তের মধ্যে বৃটেনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্বাধীন উপদেষ্টা স্যার লরি ম্যাগনাসের কাছে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন টিউলিপ।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক-অপরাধ বিভাগের কর্মকর্তারা ইতিমধ্যেই টিউলিপ এবং তার পরিবারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নথি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার অর্থায়নে পরিচালিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টিও তদন্ত করছে বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই অর্থ কেলেঙ্কারিতে টিউলিপের ভূমিকা কি ছিল তা খতিয়ে দেখছে তারা।
দ্য টাইমস বলছে, ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের জন্য টিউলিপের বিকল্প হিসেবে যাদের বিবেচনা করা হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে র্যাচেল রিভসের দুই মন্ত্রীর সহকারী। তারা হচ্ছেন, অ্যালিস্টার স্ট্রাথার্ন ও ইমোজেন ওয়াকার।
এছাড়া যারা টিউলিপের পদের জন্য বিবেচিত হতে পারেন তারা হচ্ছেন-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সংসদীয় ব্যক্তিগত সচিব (পিপিএস) ক্যালাম অ্যান্ডারসন, পরিবেশ বিভাগের পিপিএস কণিক্ষ নারায়ণ, জোশ সাইমনস ও র্যাচেল ব্লেক। এই তালিকায় আরও বেশ কয়েকজনের নাম রয়েছে। তারা হলেন-অ্যাটর্নি জেনারেল লুসি রিগবি ও অর্থনীতিবিদ টর্স্টেন বেল। এদের মধ্যে একজন মন্ত্রী পর্যায়ের সহকারী। এ দুজনকে টিউলিপের শক্তিশালী বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে।
লেবার পার্টির একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে যে, টিউলিপ কর্তৃক তদন্তের আহ্বানের অর্থ হচ্ছে-তিনি ঝুঁকিতে পড়তে ইচ্ছুক এবং তিনি পদত্যাগের পথে রয়েছেন।
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার দুই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির কাছ থেকে লন্ডনে যথাক্রমে ৭ লাখ ও ৬ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট উপহার পেয়েছেন টিউলিপ। যে তথ্য তিনি গোপন করেছিলেন। তবে বৃটেনের গণমাধ্যমে এ বিষয়ে খবর প্রকাশ হওয়ায় ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছেন টিউলিপ। ওই সম্পত্তিগুলো আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে পাওয়া সেটা অস্বীকার করেছেন টিউলিপের একজন মুখপাত্র।
ম্যাগনাসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে টিউলিপ বলেছেন, আমি স্পষ্ট যে-আমি কোনো ভুল করিনি। তবে সন্দেহ এড়াতে আমি চাই আপনি স্বাধীনভাবে বিষয়গুলো তদন্ত করুন। তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা করার কথা জানিয়েছেন বৃটেনের ওই মন্ত্রী।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ হচ্ছে, লন্ডনের চ্যানেল ৪ নিউজের সাংবাদিক হাসিনার আমলে গুম হওয়া ব্যারিস্টার আরমান সম্পর্কে টিউলিপকে প্রশ্ন করায় ওই ব্যারিস্টারের বাসায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হয়েছে। ব্যারিস্টার আরমান প্রয়াত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে। তার পুরো নাম মীর আহমেদ বিন কাসেম। তিনি বৃটেনে আইন বিষয়ে পড়াশোন করেছেন। তার বাবার পক্ষের আইনজীবীদের দলে থাকায় ২০১৬ সালে গুম হয়েছিলেন তিনি।
ব্যারিস্টার আরমানের মা টিউলিপের কাছে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে, আপনারা বাংলাদেশে সফরের সময় শান্তি প্রচারের কথা বলেছিলেন। টিউলিপকে আরমানের গুম হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন তার মা। এ বিষয় টিউলিপকে প্রশ্ন করেন ওই সাংবাদিক। তখন টিউলিপ রেগে যান এবং সাংবাদিককে সাবধান করেন। তবে ওই ঘটনার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চিঠি লিখেছেন বলে দাবি করেছেন টিউলিপ।
এমন পরিস্থিতিতে টিউলিপকে তার পদে বহাল রাখলে লেবার পার্টিও বিতর্কিত হতে পারে বলে মনে করছেন বিরোধী দলের নেতারা।
টোরি এমপি বব ব্ল্যাকম্যান বলেছেন, টিউলিপ সিদ্দিককে তার সম্পত্তির লেনদেনের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে এবং ব্যাখ্যা করতে হবে আসলে কী ঘটেছে এবং কেন। যদি তিনি তা না করেন তবে মন্ত্রী হিসেবে তিনি তার কাজ চালিয়ে যেতে পারেন না।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বৃটেনের প্রভাবশালী দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনের কিং’স ক্রস এলাকায় অবস্থিত ২ শয়নকক্ষের একটি ফ্ল্যাট ২০০৪ সালে টিউলিপকে উপহার দিয়েছিলেন আবদুল মোতালিফ নামের এক আবাসন ব্যবসায়ী। মোতালিফ বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও টিউলিপের খালা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এ খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই টিউলিপকে অর্থ এবং সিটি মন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের আওয়াজ জোরালো হচ্ছে।