মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগে মঙ্গলবার কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নিয়েছে থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী। থাই সেনাবাহিনীর দাবি, কাম্বোডিয়ার বাহিনী চুক্তি কার্যকর হওয়ার পরও থাই ভূখণ্ডে একাধিক স্থানে সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।
সোমবার মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনার পর উভয় দেশ মধ্যরাত থেকে অনির্দিষ্টকালীন ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এই চুক্তির লক্ষ্য ছিল ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তবর্তী এলাকা ঘিরে প্রাচীন মন্দির অঞ্চল নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটানো।
থাই সেনাবাহিনীর মুখপাত্র উইনথাই সুয়ারি বলেন, ‘চুক্তি কার্যকর হওয়ার মুহূর্তে কাম্বোডিয়ার বাহিনী থাইল্যান্ডের ভূখণ্ডে একাধিক এলাকায় সশস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এটি একটি ইচ্ছাকৃত যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এবং পারস্পরিক আস্থাকে বিনষ্ট করার চেষ্টার সুস্পষ্ট প্রমাণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘থাইল্যান্ড উপযুক্তভাবে এর জবাব দিতে বাধ্য হয়েছে, যা আমাদের আত্মরক্ষার অধিকার সংরক্ষণ করে।’
অন্যদিকে, কাম্বোডিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মালি সোচেতা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘কোনো অঞ্চলে কোনো ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়নি।’
তবে উভয় পক্ষই জানিয়েছে, সীমান্তে প্রতিদ্বন্দ্বী সেনা কমান্ডারদের মধ্যে নির্ধারিত সকালবেলার বৈঠক শুরু হয়েছে বা শুরু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে।
থাইল্যান্ডের সুরিন শহরের বাসিন্দা, ৩২ বছর বয়সী ওষুধকর্মী কিত্তিসাক সুকউইলাই বলেন, ‘দুই নেতাকে করমর্দন করতে দেখেছি। আশা করি এটা শুধু ক্যামেরার সামনে হাসিমুখে ছবি তোলার জন্য নয়, আর এই হাতগুলো যেন একে অপরকে পেছন থেকে ছুরি মারতে না তোলে।’
কাম্বোডিয়ার সামরোঙ শহরে, যা সীমান্ত থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে, এএফপির একজন প্রতিবেদক জানান, সোমবার রাত ১২টার আগের ৩০ মিনিটে গোলাবর্ষণের শব্দ থেমে যায় এবং সেই শান্ত অবস্থা মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বজায় থাকে।
কাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত মঙ্গলবার সকালে ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘রাত ১২টার যুদ্ধবিরতির পর থেকে ফ্রন্টলাইনে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে।’
‘সততার সঙ্গে বাস্তবায়ন প্রয়োজন’
গত বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৩৮ জন নিহত হয়েছে এবং প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন।
এই অঞ্চল ঘিরে ২০০৮ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মূলত ১৯০৭ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক প্রশাসনের অধীনে আঁকা সীমারেখা ঘিরে দুই দেশই মালিকানা দাবি করছে।
এক ক্যাম্পে অবস্থানরত ৪৫ বছর বয়সী ক্যাম্বোডিয়ান নারী ফেন নেথ বলেন, ‘আমি আমার ঘর-বাড়ি এবং সবকিছু খুব মিস করছি। যুদ্ধবিরতির খবর শুনে আমি এতটাই খুশি যে ভাষায় বোঝাতে পারছি না।’
মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং কাম্বোডিয়া এক যৌথ বিবৃতিতে এই যুদ্ধবিরতিকে ‘উত্তেজনা প্রশমনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ’ বলে উল্লেখ করেছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘তিনি উভয় দেশকে চুক্তি সম্পূর্ণরূপে মেনে চলার এবং দীর্ঘদিনের বিরোধ নিরসনের উপযোগী পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।’
উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি পেতে আগ্রহী, যাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক হুমকি এড়ানো যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তাদের কর্মকর্তারা মালয়েশিয়ায় সরাসরি শান্তি আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, চীনও আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। এই বৈঠক মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং আসিয়ান চেয়ারম্যান আনোয়ার ইব্রাহিমের উদ্যোগে পুত্রজায়া শহরে অনুষ্ঠিত হয়।
হুন মানেত ট্রাম্পকে ‘নির্ণায়ক’ সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানান। অন্যদিকে থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথম ওয়েচায়াচাই বলেন, ‘চুক্তিটি উভয় পক্ষের সদিচ্ছার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত।’
রাজকীয় জন্মদিনে কাটা পড়ল উদযাপন
সোমবার থাই রাজা মহা বাজিরালংকর্ন তার ৭৩তম জন্মদিন পালন করার কথা থাকলেও, ব্যাংককের গ্র্যান্ড প্যালেসে নির্ধারিত জনউৎসব সীমান্ত উত্তেজনার কারণে বাতিল করা হয়েছে।
এর আগে দুই দেশই যুদ্ধবিরতির নীতিগত সম্মতিতে পৌঁছেছিল, কিন্তু পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের অভিযোগ এবং হাসপাতাল লক্ষ্য করে হামলার অভিযোগে যুদ্ধবিরতির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
থাইল্যান্ড বলছে, সংঘর্ষে তাদের ১১ সেনা ও ১৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। অপরদিকে, কাম্বোডিয়া ৮ জন বেসামরিক নাগরিক এবং ৫ জন সেনার মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে।
এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ডের সীমান্ত অঞ্চল থেকে ১ লাখ ৩৮ হাজার এবং কাম্বোডিয়া থেকে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।