বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
আন্তর্জাতিক

মামদানিকে কেন আক্রমণ করছে যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদীরা

নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে ‘বিস্ময়কর’ জয় পেয়ে এক নতুন বাস্তবতা সৃষ্টি করেছেন মুসলিম প্রার্থী জোহারান মামদানি।  প্রগতিশীল এজেন্ডা—যেমন শহরজুড়ে ভাড়া স্থগিত, ট্যাক্স অর্থে শিশু যত্ন এবং দ্রুত ও নিখরচা বাস পরিষেবা—নিয়ে তিনি নির্বাচনে লড়েন এবং ২৫ জুন নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হন। 

তবে এই জয়ের পর থেকেই, বিশেষ করে ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশ মামদানির বিরুদ্ধে ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেছে-তার মুসলিম পরিচয়, প্রগতিশীল রাজনৈতিক অবস্থান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সমালোচনার কারণে।

‘জিহাদি জোম্বি’ আখ্যা ও পাকিস্তান তত্ত্ব

গত সপ্তাহে কুইন্সে একটি অনুষ্ঠানে ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীকর্মী কাজল শিঙ্গালা মামদানিকে আক্রমণ করে বলেন, ‘ও জিহাদি জোম্বি... ও মেয়র হলে নিউইয়র্ক পাকিস্তান হয়ে যাবে।’ তার এ মন্তব্যে হলভর্তি দর্শক করতালি দেন।

শিঙ্গালা ভারতীয় মিডিয়ায় অন্যতম ইসলামবিদ্বেষী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত, যিনি মুসলিমদের ধর্ষক, সন্ত্রাসী এবং তথাকথিত ‘লাভ জিহাদ’-এর অংশ হিসেবে অপবাদ দিয়ে থাকেন। 

মামদানির বিরুদ্ধে তার এসব বক্তব্য নিউ ইয়র্কের গুজরাটি সমাজ, বৈষ্ণব মন্দির ও ব্রাহ্মণ সমাজের মতো সংগঠনের মঞ্চে উঠে আসে।

মামদানি এক মেয়রাল ফোরামে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গাকে ‘মুসলিমদের গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করেন। সেই দাঙ্গার সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। মামদানি তাকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলেন—এ বক্তব্যই ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের ক্ষুব্ধ করেছে।

প্রবাসে মোদির প্রভাব ও বিরোধীদের টার্গেটিং

গুজরাটি সমাজের সঙ্গে মোদির সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১২ সালেই, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও সংগঠনের সহ-সভাপতি মানিকান্ত প্যাটেল বলেছিলেন, মোদির সঙ্গে তাদের ‘নিয়মিত যোগাযোগ’ রয়েছে।

সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে মামদানির বিরোধিতায় মাঠে নামে প্রবাসী হিন্দুত্ববাদীরা। মামদানিকে নিয়ে প্রচার করা হয় যে, তিনি নির্বাচিত হলে নিউইয়র্কে হিন্দু ব্যবসা ও পরিবার বিপন্ন হবে, শহর হয়ে উঠবে ‘দ্বিতীয় পাকিস্তান’।

মিডিয়া ও রাজনৈতিক আক্রমণ

ভারতের বিজেপি সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত গত ২৫ জুন এক ভুল তথ্যভিত্তিক পোস্টে মামদানিকে অভিযুক্ত করেন টাইমস স্কয়ারে হিন্দুদের গালাগাল এবং রামকে অপমান করার জন্য। বাস্তবে মামদানি তখন বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের সমালোচনা করছিলেন, যার পটভূমি ১৯৯২ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও ২,০০০ মুসলমান নিহত।

কংগ্রেস নেতা অভিষেক সিংভি-ও এক্সে লেখেন, ‘যখন মামদানি মুখ খোলে, পাকিস্তানের পিআর টিম ছুটি নেয়।’

যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় উগ্রপন্থিদের প্রভাব

নিউ জার্সি ভিত্তিক ‘ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুমো’  নামক একটি গোষ্ঠী মামদানির বিরুদ্ধে হাজার হাজার ডলার খরচ করে ব্যানার উড়িয়েছে—‘গ্লোবাল ইনতিফাদা থেকে নিউ ইয়র্ক সিটি বাঁচাও, মামদানিকে প্রত্যাখ্যান করো।’

এই প্রচারের অন্যতম সংগঠক সাথ্যানারায়ণ দোসাপাতি ট্রাম্প-সমর্থিত এবং ভারতে বিজেপি রাজনীতিতে জড়িত।

প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এরিক অ্যাডামস, যিনি এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াচ্ছেন, মামদানিবিরোধী একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও, ২০টিরও বেশি আন্তঃধর্মীয় সংগঠনের চিঠির পর তিনি অংশগ্রহণ থেকে সরে দাঁড়ান।

মামদানির সমর্থনে একতা

তবে মামদানির বিরুদ্ধে এসব আক্রমণ সব ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব করে না। হিন্দুস ফর হিউম্যান রাইটসের নির্বাহী পরিচালক সুনিতা বিশ্বনাথ বলেন, ‘ভারতীয়-আমেরিকানদের একটা বড় অংশই এই ঘৃণা সমর্থন করে না। আমরা বিভেদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকব।’

রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রুশকে বলেন, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের এই ঘৃণ্য আক্রমণ নিউইয়র্কবাসীদের ধোঁকা দিতে পারবে না।’

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ডেভিড লুডেন বলেন, ‘হিন্দুত্ব ও জায়োনিজম একই জাতিগত সার্বভৌমত্বের দাবির ওপর দাঁড়ানো মতবাদ... মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে, জাতিগত শুদ্ধতা কায়েম করার চেষ্টা চলছে।’

ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক জোট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মামদানিকে ‘ ১০০% কমিউনিস্ট উন্মাদ’ আখ্যা দেন এবং বলেন, ‘এই লোকটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক।’ 

তিনি আরও অভিযোগ তোলেন,  মামদানি একটি বামপন্থি বিপ্লব চালাচ্ছেন। 

এদিকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানান আহমেদ বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদীদের ট্রাম্প-সমর্থন ও মামদানির বিরুদ্ধে তৎপরতা বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদী জোটের অংশ।’

তিনি জানান, অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগ (এডিএল), হিন্দু আমেরিকা ফাউন্ডেশন (এইচএফ), বিজেপি এবং ট্রাম্প—সকলেই মামদানির মতো প্রগতিশীল প্রার্থীকে দমন করতে চায়, কারণ তিনি ধর্মীয় ও জাতিগত জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।

বাঙালি, পাঞ্জাবি ও প্রবাসী হিন্দুদের সমর্থন

ড্রাম (DRUM)-এর নির্বাহী পরিচালক ফাহদ আহমেদ বলেন, মামদানির প্রতি উল্লেখযোগ্য সমর্থন এসেছে গায়ানিজ, নেপালি ও বাংলাদেশি হিন্দুদের কাছ থেকে—যারা হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করেন। 

তিনি বলেন, মামদানির পাঞ্জাবি শিকড় এবং নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ধর্মঘটে তার ভূমিকা তাকে পাঞ্জাবি ও শিখ সম্প্রদায়ের কাছেও জনপ্রিয় করে তুলেছে।

তিনি আরও বলেন, নিউইয়র্কের সচ্ছল হিন্দু পেশাজীবীদের একাংশও মামদানিকে সমর্থন করছেন।

মামদানি কেন হুমকি?

ফাহদ আহমেদ বলেন, ‘মামদানির মুসলিম ও ভারতীয় পরিচয়, তার ফিলিস্তিনপন্থি অবস্থান এবং হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান তাকে একটি রাজনৈতিক বিপ্লবের মুখ করে তুলেছে। হোক সেটা জায়োনিস্ট বা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী—তারা চায় না কেউ তাদের সমালোচনা করুক। আর কেউ যখন নির্বাচিত হয়ে সেই কাজটা করে, তখন সেটাই হয়ে যায় তাদের সবচেয়ে বড় হুমকি।’

(মিডল ইস্ট আই-এ প্রকাশিত নিউ ইয়র্ক সিটির লেখক সায়মা মোহাম্মদের লেখা অবলম্বনে)

এই সম্পর্কিত আরো