রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
✔ বাংলা টেক্সট কনভার্টার
শিরোনাম
advertisement
আন্তর্জাতিক

এবার আল আকসায় হামলার পরিকল্পনা ইসরায়েলের !

ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর যুদ্ধকে বৈধতা দিতে একের পর এক ন্যারেটিভ গড়ছে তেল আবিব। শুরুতে বলা হয়েছিল, ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা’ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে।

পরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় দাবি করা হয়, ইরানের ইসলামিক শাসনব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করাই ছিল হামলার উদ্দেশ্য। সর্বশেষ, ইসরায়েলের উচ্চপর্যায়ের এক কর্মকর্তা সরাসরি হুমকি দিয়েছেন- তেহরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকে হত্যা করা হবে।

এই উত্তপ্ত ও বিপজ্জনক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখন প্রশ্ন উঠছে- ইসরায়েল কি আল-আকসা মসজিদে হামলা চালিয়ে তার দায় ইরানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চায়?

ইরান যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, তখন জেরুজালেমের দখলকৃত পূর্ব অংশে থাকা ফিলিস্তিনিরা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।


মিসাইলগুলো সরাসরি তাদের দিকে না গেলেও, তা ছিল যথেষ্ট কাছাকাছি। এই পটভূমিতে নতুন করে সামনে এসেছে বহু পুরোনো এক সন্দেহ : আল আকসা কি হতে যাচ্ছে আরেকটি ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশনের’ লক্ষ্যবস্তু?

তুরস্কের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদে তুবা কোর সতর্ক করে বলেছেন, এই মুহূর্তটি ইসরায়েলের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। তারা চাইলে মোসাদের মাধ্যমে এমন একটি হামলা ঘটাতে পারে যাতে দোষ চাপানো যায় ইরানের ঘাড়ে।

তিনি আরও বলেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি নেতাদের বক্তব্যে বাইবেলীয় ভাষ্য এবং ধর্মীয় উন্মাদনা যেভাবে জায়গা করে নিচ্ছে, তাতে বোঝা যায়- গাজার অভিযানের পেছনে রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় ও মতাদর্শিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

উল্লেখ্য, আল আকসা মসজিদ, যা মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান, তেল আবিব থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ দূরত্বকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, যুদ্ধের কুয়াশায় ঢাকা এমন সময় একটি হামলা হতে পারে ইসরায়েলের বহু দিনের পরিকল্পনার অংশ- একদিকে ইরানকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয় করা, অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিয়ে পবিত্র স্থাপনাটির ধ্বংসযজ্ঞ চালানো।

সাম্প্রতিক একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, কট্টর ইহুদি ধর্মীয় নেতা রাবাই ইউসেফ মিজরাচি বলেন, আমি হলে আল-আকসায় বোমা ফেলতাম আর দোষ দিতাম ইরানের ওপর।

ইতিহাসবিদ জাকারিয়া কুরসুন বলেন, এটা হবে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো। একদিকে মুসলিম বিশ্বে সুন্নি-শিয়া বিভাজনকে বাড়ানো হবে, অন্যদিকে আল আকসা ধ্বংসের জন্য মানসিকভাবে মুসলমানদের প্রস্তুত করা হবে।

আল আকসা মসজিদ ঘিরে ইসরায়েলের পরিকল্পনা নতুন নয়। ‘টেম্পল মাউন্ট মুভমেন্ট’ -এর পেছনে দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ইসরায়েল সরকার সহযোগিতা করে আসছে। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল আকসা এবং ডোম অব দ্য রক গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে একটি ইহুদি উপাসনালয় গড়ে তোলা।

২০১৮ সালে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেতজ এক অনুসন্ধানে জানায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ পরামর্শক কেনেথ আবরামোভিৎজ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী এলি বেন-দাহান এই প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিলেন। ২০২২ সালে ‘টেম্পল ইনস্টিটিউট’ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘লাল গরু’ আমদানি করে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই লাল গরুর ছাই ব্যবহার করেই নতুন উপাসনালয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবে।

বিশ্লেষক কোর বলেন, ‘উপাসনালয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। এখন শুধু আল আকসা ধ্বংস ও ধর্মীয় আচার শুরুর অপেক্ষা।’

১৯৬৯ সালে এক অস্ট্রেলীয় খ্রিস্টান আল আকসা মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সালাহউদ্দিনের নির্মিত ঐতিহাসিক মিনার সে হামলায় ধ্বংস হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ইসরায়েলি আদালত হামলাকারীকে মানসিকভাবে অযোগ্য ঘোষণা করে দেশে পাঠিয়ে দেয়, যার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ ছিল।

১৯৯৪ সালে হেবরনের ইব্রাহিমি মসজিদে এক ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী গুলি চালিয়ে ২৯ ফিলিস্তিনি মুসল্লিকে হত্যা করে। এরপরই ইসরায়েল পুরো মসজিদ এলাকা দুই ভাগ করে ৬৩ শতাংশ ইহুদিদের জন্য বরাদ্দ করে।

১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুজালেম দখল করলেও আল আকসার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ইসরায়েল। এই অসম্পূর্ণতা বহু দিন ধরেই তেল আবিবের একটি গভীর হতাশার কারণ। বিশ্লেষক কোরের মতে, ‘ইসরায়েল যা করতে চায়, তার পরিকল্পনা বহু আগে করে এবং ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করে। যুদ্ধ, বিশ্ব রাজনীতির জটিলতা ও মুসলিম বিশ্বের ভাঙন এখন তাদের সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।’

বর্তমান যুদ্ধময় মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিটি আঘাত এবং প্রতিক্রিয়া একটি গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বহন করছে। আল আকসা মসজিদকে কেন্দ্র করে ইসরায়েল যদি সত্যিই কোনো কৌশলগত ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ হামলার পথে হাঁটে, তবে তা শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে।

এখন প্রশ্ন হলো- বিশ্ব কি সেই ঝড়ের জন্য প্রস্তুত?

সূত্র : টিআরটি ওয়ার্ল্ড

এই সম্পর্কিত আরো