৮০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যখন পুরনো মিত্ররা আলাদাভাবে স্মরণসভা পালন করছে, তখন বাস্তবতা যেন বারবার জানান দিচ্ছে– আমরা এক ভয়াবহ নতুন যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছি। হয়তো ইতোমধ্যেই তার ভেতরে ঢুকে পড়েছি।
প্যাক্স আমেরিকানা-এর ভাঙন, একের পর এক জড়িয়ে পড়া সংঘাত, রাষ্ট্রীয় সহিংসতার লাগামহীন উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়া– সবকিছুই যেন একযোগে জানিয়ে দিচ্ছে, আমরা এক বিপজ্জনক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিরক্ষা কৌশল পর্যালোচনামূলক উপদেষ্টা ফিওনা হিল বলছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, তবে আমাদের সেটা স্বীকার করে নেওয়ার সাহস নেই’।
বিশ্বায়ন ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির জগতে কেউহ যেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেই– এই উদ্বেগ নতুন নয়। ১৯৬৭ সালে এডমান্ড লিচ এবং ১৯৯৯ সালে অ্যান্থনি গিডেনসের রেইথ লেকচারস-এ বিষয়টি উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থা যেভাবে ধসে পড়ছে, তা অভূতপূর্ব।
সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিব্যান্ড চ্যাথাম হাউসে বসে একবার বলেছিলেন, ‘বিশ্ব সব সময়ই পরিবর্তনের মধ্যে থাকে। কিন্তু এখনকার মতো ভূরাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা খুব কম সময়েই এসেছে’।
তার মতে, মার্কিন নেতৃত্বে পরিচালিত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও তার পরিবর্তে কী আসছে, সেটাই অস্পষ্ট।
একইসুরে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও। তার ভাষায়, ‘সবাই যেন হঠাৎ করে অচেনা এক বাস্তবতার মধ্যে পড়ে গেছেন। এই বিশৃঙ্খলা থেকে মানুষ এখন নতুন পথ খুঁজছে। সম্পর্ক, অবস্থান সব কিছু নতুন করে ভাবছে’।
এদিকে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘ট্রাম্পের আমলে মার্কিন কূটনৈতিক নীতির ওলট-পালট বিশ্বজুড়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। সবাই জিজ্ঞেস করছে– কী হচ্ছে এসব?’
আইনের শাসনের পতন, যুদ্ধের জয়জয়কার
এই যেমন- গাজায় আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ত্রাণ অবরোধ চলছে টানা তিন মাস ধরে। দখলদার ইসরাইল গাজা, ইয়েমেন, লেবানন ও সিরিয়ায় একযোগে বোমা মারছে। এরপরও তেলআবিব চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানেও বোমা মারার অনুমতি দেয়।
যদিও ট্রাম্প এ বিষয়ে কিছুই বলছেন না। চুপ করে আছেন। যদিও তার নীতির প্রতিফলনই যেন ঘটেছে ইসরাইলের কট্টরপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচের বক্তব্যে, ‘গাজাকে ধ্বংস করে ফেলতে হবে, ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে হবে’।
তবে তার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন দিয়ে বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রেভো বলেছেন, ‘ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়াটা যুদ্ধের একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, এটা চরম লজ্জাজনক’।
ইসরাইল বিরোধী সুর চড়িয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁও। তার ভাষায়, ‘যদি রাশিয়ার ইউক্রেনে আগ্রাসনের আমরা নিন্দা করি, তাহলে গাজায় যা হচ্ছে তা নিয়েও চুপ থাকা যায় না’।
তিনিও অবিলম্বে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ স্বাভাবিক করার জোর তাগিদ দিয়েছেন।
মার্কিন অনুপস্থিতি, সংঘাতের বিস্তার
এদিকে গাজার পাশাপাশি সুদানে, ইয়েমেনে, কাশ্মীরে– সব জায়গায় সহিংসতা বাড়ছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যেন নির্বিকার। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান পরস্পরের যুদ্ধবিমান গুলি করছে, অথচ ওয়াশিংটনে এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই– এমনকি ভারত বা পাকিস্তানে কোনো মার্কিন রাষ্ট্রদূতও নেই।
তবে অবশেষে যেন ঘুম ভাঙল ট্রাম্প প্রসাশনের। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে দিয়ে তড়িঘড়ি আলোচনা করে যুদ্ধ থামালেন ট্রাম্প। সেই কথা আবার নিজের ট্রুথ সোশ্যালের মাধ্যমে জানিয়েও দেন সবাইকে। যা বিশ্বনেতাদের প্রশংসাই কুড়িয়েছে শেষমেশ।
এর আগে ১৯৯৯ সালের উত্তেজনার সময় যেমনটা করে দেখিয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ব্যক্তিগতভাবে চাপ দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। ২৬ বছরের মাথায় সেই একই কাজ করে দেখালো বর্তমান মার্কিন নেতৃত্ব।
যদিও গাজা ও ইউক্রেনের যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্র আজ অবধি দ্বিধান্বিত। তবে ফিওনা হিল বলছেন, চলমান ইউক্রেন যুদ্ধই আসল ‘সিস্টেম চেঞ্জিং’ সংঘাত। রাশিয়া একাই নয়, তার পাশে আছে চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান– যাদের কেউ ড্রোন বানাচ্ছে, তো কেউ সৈন্য পাঠাচ্ছে।
রাশিয়া ও তার মিত্ররা এই যুদ্ধকে মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে তুলে ধরছে। ট্রাম্প নিজেও এই ব্যাখার সঙ্গে সহমত। তার স্বপ্ন, পুতিন ও শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আবার যেন ১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনের পুনরাবৃত্তি হয়, আর ইউরোপ তা দূরে বসে চেয়ে চেয়ে দেখবে।
নতুন এক ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা জোটের জন্ম
তবে ইউরোপ এখন আর বসে নেই। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এক যৌথ অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছে– ইউক্রেনকে সহায়তা দিতে ও রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলা করতে। পোল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্য মিলে Weimar+ গোষ্ঠীর নেতৃত্বে গঠিত হচ্ছে ইউরোপীয় সুরক্ষা বলয়।
জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক-ভাল্টার স্টেইনমায়ার বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা দ্বিমুখী যুগান্তকারী পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যার একদিকে রাশিয়ার আগ্রাসন, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত বিচ্যুতি। বিংশ শতকে যে আন্তর্জাতিক কাঠামো ছিল, তার অবসান ঘটছে’।
সংক্ষেপে বলা যায়, বর্তমান বিশ্ব এক বিশাল অস্থিরতার মধ্যে প্রবেশ করেছে। কেউ কেউ বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এখনো শুরু হয়নি– আবার কেউ বলছেন, আমরা হয়তো তা টেরই পাইনি। তবে যুদ্ধ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
পুরনো দিনের বিশ্বযুদ্ধ মানেই ছিল স্পষ্ট মিত্র ও প্রতিপক্ষ, রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের সংঘর্ষ। তবে আজকের যুদ্ধ অপ্রতিসীম পরিসরে বিস্তৃত, ছদ্ম যুদ্ধে আচ্ছন্ন এবং অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ছায়ায় পরিচালিত। একে অস্বীকার করা মানেই প্রস্তুত না থাকা।
সুতরাং, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যদি ঘোষিত না-ও হয়ে থাকে, বাস্তবতা বলছে—আমরা হয়তো তাতে পা রেখেই ফেলেছি।