পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মির। অথচ বিশ্বের অন্যতম সামরিকায়িত একটি অনিন্দ্যসুন্দর উপত্যকা এটি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর একাধিক যুদ্ধ, অস্থিরতা আর কূটনৈতিক অচলাবস্থার সাক্ষী হয়েছে কাশ্মির। দশকের পর দশক প্রতিবেশী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু এই অঞ্চল। দুটি বড় যুদ্ধ ছাড়াও একাধিকবার হয়েছে সংঘর্ষ। কাশ্মির ইস্যুতে বিরোধ রয়েছে ভারত-চীনের মধ্যেও। কেন ও কীভাবে তিন দেশের উত্তেজনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে কাশ্মির, এক ঝলকে দেখে নেয়া যাক।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে ভারতের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। স্বাধীনতা লাভ করে ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু কাশ্মির প্রশ্নটি রয়ে যায় অনিষ্পন্ন।
কাশ্মিরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং স্বাধীন থাকতে চাইলেও তার অবস্থান ছিল দুর্বল। ছাড় দিতে চায়নি ভারত বা পাকিস্তান— কোনো পক্ষই। ফলে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তা।
সে বছরের অক্টোবরে কাশ্মিরে হামলা চালায় পাকিস্তানি বিদ্রোহীরা। তাদের মোকাবিলায় ভারতের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা নেন হরি সিং। ভারতের সেনাবাহিনী ভূখণ্ডের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। স্বায়ত্তশাসন তথা বিশেষ মর্যাদার শর্তে ভারতের সাথে যুক্ত হয় জম্মু, কাশ্মির ভ্যালি ও লাদাখ। অন্যদিকে আজাদ কাশ্মিরসহ উত্তরের অংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কাশ্মির নিয়ে বিরোধ তখনও থেমে থাকেনি। ১৯৬২ সালে পূর্ব অংশ আকসাই চিন দখল করে নেয় চীন।
মূলত, কাশ্মিরের এক লাখ এক হাজার তিনশ আটত্রিশ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে পঁচাশি হাজার আটশ ছিয়াল্লিশ বর্গকিলোমিটার। আর আকসাই চিন নামে পরিচিত অংশের আয়তন সাঁইত্রিশ হাজার পাঁচশ পঁচান্ন বর্গকিলোমিটার।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে আবারও কাশ্মির সীমান্ত নিয়ে বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়ায় ভারত ও পাকিস্তান। দুই দেশের সেনাদের ব্যাপক প্রাণহানির পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয় যুদ্ধবিরতি।
১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ রেখা মেনে চলতে রাজি হয় উভয় দেশ। তবে উত্তেজনা থেকে যায়। ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের মাধ্যমে আবারও সংঘর্ষ বাঁধে। কাশ্মির সীমান্তে চীন-ভারত সম্পর্কেও একাধিকবার উত্তেজনা দেখা দেয়।
দশকের পর দশক পেরিয়ে গেলেও বিরোধের অবসান হয়নি। ৮০’র দশকের শুরু থেকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও আন্দোলন দানা বাঁধে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে ওঠে সশস্ত্র গোষ্ঠী। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করে দিল্লি। কয়েক দশকে প্রাণ গেছে হাজার হাজার মানুষের।
২০১৬ সালে উরিতে হামলায় নিহত হয় ১৯ ভারতীয় সেনা। জবাবে পাকিস্তান সীমান্তে চালানো হয় সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কনভয়ে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় ৪০ সেনা। জবাবে বালাকোটে বিমান হামলা চালায় ভারত।
পরবর্তীতে ঘটে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। ওই বছরের আগস্টে জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে মোদি সরকার। রাজ্যটি ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করা হয়। মোদি প্রশাসনের দাবি, এরপর কাশ্মিরে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে, বেড়েছে পর্যটক। তবে সামরিক-বেসামরিক হত্যা ও গুপ্তহত্যা এখনও বন্ধ হয়নি। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত—পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলা।