চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচনের প্রচার জমে উঠেছে। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা।
এদিন পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে দেখা গেছে প্রার্থীদের সরব উপস্থিতি। কেউ মসজিদে জুমার নামাজ শেষে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছেন, কেউ হল ও কটেজে ঘুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, পাশাপাশি বিলিয়েছেন লিফলেট ও পোস্টার। প্রচার চালানোর পাশাপাশি গতকাল দুটি প্যানেল নিজেদের ইশতেহার ঘোষণা করেছে।
আগামী ১৫ অক্টোবর চাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। ফলে এখন প্রার্থীরা ব্যস্ত শেষ সময়ের প্রচারে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মসজিদ, স্টেশন এলাকা, শাটল ট্রেন, শহীদ মিনার, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, ঝুপড়ি— সব জায়গাতেই ছিল প্রার্থীদের ব্যস্ততা।
ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য প্যানেল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ব্যস্ত সময় পার করেছেন ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণে। প্রার্থীরা ভোটারদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন, শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন, দোয়া চাইছেন।
ভোটের আগে শেষ জুমাবার হওয়ায় ক্যাম্পাসের প্রতিটি মসজিদে ভাগ হয়ে নামাজ আদায় করেন ছাত্রদলের প্যানেলের প্রার্থীরা। পরে তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। জুমার নামাজের পর বিভিন্ন হলের কক্ষে কক্ষে গিয়ে প্রচার চালান।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন এলাকা, বিভিন্ন অনুষদ ঝুপড়ি, শাটল ট্রেন, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠেও ভোটারদের কাছে ভোট ও দোয়া চান তারা। পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এই প্যানেলের প্রার্থীরা।
ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন হৃদয় বলেন, ‘আমরা হলে, ঝুপড়িতে যেখানে শিক্ষার্থীদের সমাগম রয়েছে, সেসব জায়গায় প্রচার চালিয়েছি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমরা দারুণ আগ্রহ ও উদ্দীপনা লক্ষ করেছি, বিশেষ করে এত বছর পর চাকসু নির্বাচন হওয়ায় সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন।’
একই প্যানেলের এজিএস প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক কালবেলাকে বলেন, ‘সাপ্তাহিক বন্ধের দিন হওয়ায় শুক্রবার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম ছিল। আমরা স্টেশন এলাকা, মসজিদ প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীদের চাওয়াগুলো জানার চেষ্টা করছি। শিক্ষার্থীরা আমাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বলছে। আমরা তা লিখে রাখছি।’
বিভিন্ন মসজিদ প্রাঙ্গণে ভোটারদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থীরা। পরে হল ও কটেজে প্রচার চালান তারা। প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী সাঈদ বিন হাবিব বলেন, ‘জুমাবার হওয়ায় আজ শুধু মসজিদ ও কটেজ এলাকায় প্রচার চালানো হয়েছে। সন্ধ্যায় আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও কটেজে প্রচার চালিয়েছি। শনিবারও একইভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন হলে ও কটেজে প্রচার চালানো হবে।’
অন্যদের মতো মসজিদে ভাগ হয়ে নামাজ পড়েছেন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী সম্মিলন প্যানেলের প্রার্থীরা। সকাল থেকেই শুরু হয় তাদের প্রচার। এই প্যানেলের ভিপি প্রার্থী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বন্ধের দিনে আমরা সকাল থেকেই প্রচার চালিয়েছি। কটেজ, শহীদ মিনার, ঝুপড়িসহ মোটামুটি সব জায়গায় আমরা প্রচার চালিয়েছি। আমরা ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। ১৫ তারিখ নির্বাচন সুষ্ঠু হলে শিক্ষার্থীদের মতামত আমাদের পক্ষেই থাকবে বলে আশাবাদী।’
সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের প্রার্থীরাও মসজিদ কেন্দ্রিক, বিভিন্ন হল, কটেজে প্রচার চালিয়েছে। প্যানেলের জিএস পদপ্রার্থী সাকিব মাহমুদ রুমি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে প্রচার চালিয়েছি। যেহেতু মসজিদের আঙিনায় প্রচার আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে, তাই আমরা আঙিনার বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি এবং সেখানে প্রচার করেছি। সন্ধ্যার পর আমরা বিভিন্ন হলে এবং কটেজে প্রচার চালিয়েছি।
এ ছাড়া অন্যান্য প্যানেলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরাও শুক্রবার প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করেন।
দুই প্যানেলের ইশতেহার ঘোষণা : এদিকে প্রচারের পাশাপাশি গতকাল বুদ্ধিজীবী চত্বরে দুটি প্যানেল তাদের আনুষ্ঠানিক ইশতেহার ঘোষণা করেছে। একদিকে ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ সাত দফা ইশতেহারে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু, চবি মেডিকেলকে ৩০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে রূপান্তর ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অঙ্গীকার করেছে। অন্যদিকে, ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ ২৪ দফা ইশতেহারে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক জবাবদিহি, স্মার্ট আইডি কার্ড, অনলাইন প্রশাসনিক সেবা চালুসহ বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের ইশতেহারে বলা হয়, শাটল ট্রেনের শিডিউল বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সংযোগ ও চট্টগ্রামের আশপাশের উপজেলাগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা বগি ও চক্রাকার বাস সার্ভিস চালুর কথাও রয়েছে এতে।
স্বাস্থ্য খাতে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু, চবি মেডিকেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাড়ানো, প্রতিটি হলে ফার্মেসি ও টিকা সুবিধা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ এবং পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আবাসন খাতে স্বল্পমেয়াদে বাড়ি ভাড়া নিয়ে হোস্টেল চালু, দীর্ঘমেয়াদে নতুন হল নির্মাণ ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছর ১ হাজার শিক্ষার্থীকে আবাসন ভাতা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে।
এ ছাড়া ইশতেহারে প্রশাসনকে ‘শিক্ষার্থীবান্ধব’ করতে সব সেবা ডিজিটালাইজ, গবেষণার ফান্ড চালু, শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে স্কলারশিপ চুক্তির প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। সবুজ ক্যাম্পাস গড়তে সিসিটিভি, পর্যাপ্ত আলোকসজ্জা, ডাস্টবিন, সাইকেল ব্যবহারে উৎসাহ ও ‘জোবাইক’ ফিরিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে। পাশাপাশি দুই বীর শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ও ফরহাদ হোসেনের স্মরণে ‘জুলাই স্মৃতি ম্যুরাল’ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের ইশতেহারে বলা হয়েছে, প্রতিটি বিভাগে একাডেমিক উপস্থিতি ও পাঠদান তদারকিতে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি থাকবে, যা সরাসরি ছাত্র সংসদে প্রতিবেদন দেবে। শিক্ষক উপস্থিতি ও কোর্স কাভারেজ উন্মুক্ত বোর্ডে প্রকাশ করা হবে।
পাশাপাশি প্রতি সেমিস্টারে ‘ওপেন সিলেবাস পর্যালোচনা সভা’ চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। ‘স্মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়’ গড়তে ‘একটি স্মার্ট কার্ড’ চালুর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে গ্রন্থাগার, বাস, ক্যাফেটেরিয়া, প্রশাসনিক সেবাসহ সব কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাবে। এ ছাড়া ফল দেখা, ফি প্রদান ও সনদপত্র আবেদনও হবে অনলাইনে।
অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য গঠন করা হবে ‘শিক্ষার্থী সহায়তা তহবিল’। সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এতে অনুদান দিতে পারবে। ইশতেহারে আরও রয়েছে হল দখলদারিত্ব বন্ধে স্বচ্ছ সিট বরাদ্দ পদ্ধতি, ‘শিক্ষার্থী অধিকার পর্যবেক্ষণ সেল’ গঠন, স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য ‘ক্যাম্পাস সংবাদকক্ষ’, সংসদের ব্যয় প্রকাশে ‘ওপেন মিনিটস পোর্টাল’ চালু, প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত ‘উপাচার্য সংলাপ’ চালু এবং সবুজ, প্লাস্টিকমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ার উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি।